দাঁত, মাঢ়ি ও মুখের কিছু সমস্যা ও তার প্রতিকার

দাঁত, মাঢ়ি ও মুখের কিছু সমস্যা ও তার প্রতিকার

কথায় বলে ‘দাঁতের সাথে আঁতের সম্পর্ক।' দাঁত আমাদের মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সুন্দর দাঁত আমাদের হাসির সৌন্দর্য বর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সর্বোপরি খাবার ভালভাবে চিবিয়ে হজম করার জন্য মজবুত ও সুস্থ দাঁতের প্রয়োজন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে দাঁত ক্ষয়ে যায়। ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত থেকে যে মারাত্মক সংক্রমণ হয়ে থাকে তা শরীরের অপর অংশেরও ক্ষতিসাধন করে থাকে। তবে মুখ ও দাঁতের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে শুধু পরিষ্কারের বিষয়টিই যথেষ্ট নয়, বরং সঠিক এবং নিয়মিত পরিচর্যার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অনেকে অভিযোগ করে থাকেন যে, নিয়মিত দাঁত মেজে থাকি, তারপরও দাঁতের সমস্যার কোনও অন্ত নেই। এরা দাঁত পরিষ্কার করেন ঠিকই কিন্তু এদের পদ্ধতিগত কিংবা ব্যবহারগত ত্রুটি থেকে যায়। যেমন- কেউ ব্রাশ ব্যবহার করে থাকেন কেউ মেসওয়াক আবার কেউবা আঙ্গুল দ্বারা দাঁত মেজে থাকেন।

মাজন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কেউ ব্রাশের সাথে পেস্ট, কেউ পাউডার আবার আর্থ সামাজিক অবস্থানে যারা নিম্ন শ্রেণীর তারা ছাই, মাটি, কয়লা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। এ ধরনের মাজন ব্যবহার করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ, এগুলো ব্যবহারে দাঁত পরিষ্কার হয় ঠিকই কিন্তু দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে হিতে বিপরীত হয়ে থাকে। এতে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়ে দাঁত সিন্‌ সিন্ করতে থাকে। দাঁতের গোড়ার মাংসপেশী সরে গিয়ে দাঁত দুর্বল হয়ে পড়ে । অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা গরম খেলে দাঁত সিন্‌ সিন্ করা, দাঁত ব্যথা ইত্যাদি হয়ে থাকে। তাই দাঁত সুরক্ষার জন্য বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সঠিক উপায়ে দাঁতের পরিচর্যা করতে হবে। আর এজন্য সঠিক উপায়ে পরিচর্যা ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকে নজর দেওয়া উচিত। আমাদের দেশে একটি প্রচলিত নিয়ম আছে যে, ঘুম থেকে উঠে দাঁত পরিষ্কার করা। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ঠিক নয়, বরং সকালে নাস্তার পর এবং রাতে ঘুমের পূর্বে দাঁত পরিষ্কার করা উচিত। কারণ অপরিষ্কার মুখ নিয়ে ঘুমোলে মুখের মধ্যস্থিত ব্যাকটেরিয়া রোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এছাড়া ঘুমের মধ্যে লালা নিঃসরণের পরিমাণ কমে যায় বলে মুখ ও দাঁতের রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই ঘুমোতে যাবার পূর্বে দাঁত মাজার অভ্যেস করা উচিত।

কিভাবে দাঁত ব্রাশ করবেনঃ

১। প্রথমে ব্রাশটিকে আড়াআড়ি ভাবে ধরতে হবে যেন ব্রাশের ব্রিসেলস্ গুলো দাঁতের গোড়ায় দাঁত বরাবর লম্বাভাবে থাকে।

২। ওপরের দাঁত ওপর থেকে নিচে এবং নিচের দাঁত নিচ থেকে ওপরের দিকে মাজতে হবে।

৩। এভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাঁতের ভেতরের দিক এবং বাইরের দিক ব্রাশ করতে হবে, যেন ব্রাশের ব্রিসেল গুলো দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্থানে জমে থাকা খাদ্যকনা দূর করতে পারে।

৪। দাঁতের একপাশ থেকে অন্যপাশে মাজা যাবে না।

৫। ওপরের চোয়ালের ডান দিকের ভেতরের পিঠ থেকে দাঁত ব্রাশ শুরু করতে হবে।

কতক্ষণ সময় ব্রাশ করবেন?

দাঁত ব্রাশ নিয়ে জনমনে বিভিন্ন ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন বেশি সময় ধরে ব্রাশ করলে দাঁতের জন্য ভাল। আসলে দাঁত ব্রাশের বিজ্ঞানসম্মত সময় হলো ২ থেকে ৩ মিনিট।

দিনে কতবার ব্রাশ করবেন?

বিজ্ঞানসম্মত ভাবে দিনে দুইবার ব্রাশ করা উচিত। রাতে ঘুমানোর পূর্বে এবং সকালে নাস্তার পরে।

কি দিয়ে ব্রাশ করবেন?

দাঁত মাজা অবশ্যই ব্রাশ ও পেস্ট দিয়ে করা উচিত। ব্রাশের পরিবর্তে মেসওয়াক ব্যবহারও বিজ্ঞানসম্মত। নিমের ডাল, জয়তুনের ডাল ইত্যাদি আঁশযুক্ত ডাল দিয়ে মেসওয়াক করা ভাল। এসব ডাল ‘ডেন্টাল ক্যারেজ' প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। কারণ এগুলো থেকে ফ্লোরাইডের একটি প্রাকৃতিক উৎস পাওয়া যায়।

দাঁতের কিছু সাধারণ রোগ ও তার নিরাময়ের ব্যবস্থাঃ

পায়োরিয়াঃ

পায়োরিয়া হলে মাঢ়ি দিয়ে রক্ত পড়ে এবং মাঢ়িতে যন্ত্রণা হয়। মাঢ়ি লাল হয়ে ফুলে ওঠে। দাঁত ও মাঢ়ি ঠিকমত পরিষ্কার না করলে এবং যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার না খেলে পায়োরিয়া রোগ হয়।

পায়োরিয়া এড়ানোর উপায়ঃ

১। প্রতিবার খাওয়ার পর দাঁত ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে।

২। দাঁতের ফাঁকে যে খাদ্যকনা জমে থাকে তা পরিষ্কার রাখতে হবে।

৩। দাঁত এবং মাঢ়ির মাঝখানে হলদে রঙের যে পর্দা পড়ে সেগুলো পরিষ্কার করে কুসুম গরম লবণ-পানি দিয়ে কুলকুচা করতে হবে।

৪ । মিষ্টি ও আঠালো খাবার পরিত্যাগ করতে হবে।

৫। দাঁতের ফাঁকে আঁটকে যায় এ ধরনের আঁশযুক্ত খাবার পরিত্যাগ করতে হবে।

৬। ভিটামিনে ভরা খাবার যেমন- দুধ, ডিম বিভিন্ন ফলমূল এবং ঘন রঙের শাক সব্‌জি খেতে হবে।

জীবনভর দাঁত সুরক্ষার জন্য কতিপয় উপদেশঃ

১।  নিয়মিত সঠিক উপায়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে।

২। দাঁত মাজার পর নিয়মিত মাঢ়ি ম্যাসেজ করতে হবে।

৩। প্রধান খাবারের মধ্যবর্তী সময়টুকু মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে।

৪ । বছরে এক থেকে দু’বার মুখ ও দাঁত পরীক্ষা করতে হবে।

৫ । দাঁতে কোনও গর্ত থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।

৬। শিশুদেরকে ঘুমন্ত অবস্থায় ফিডার না দেওয়াই ভাল।

মুখের একটি বিব্রতকর সমস্যাঃ

ফুলের মনোমুগ্ধকর সুবাস মানুষকে মোহিত করে। তাই মানুষ মাত্রই আবিষ্ট হয়ে ফুলের প্রতি আকর্ষিত হয়। পক্ষান্তরে মানুষ যদি ময়লার ডাস্টবিন কিংবা ট্যানারীর পাশ দিয়ে যায় তবে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে থাকে। এমন দুর্গন্ধ যদি মানুষের মুখ থেকে বের হয় তবে কেমন বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হবে একবার ভেবে দেখুন তো? যার মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয় সে তা টের পায় না। টের পায় তারাই যারা তার কাছাকাছি থাকে। মুখে দুর্গন্ধ কারও জন্যই সুখকর নয়। মুখে দুর্গন্ধ হওয়ার নানাবিধ কারণ আছে। যথাসময়ে মুখ ও দাঁত পরিষ্কার না করার কারণে খাদ্যকনা পঁচে গিয়ে মুখে দুর্গন্ধ হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে কিছু রোগের কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।

চিকিৎসাঃ

মুখে দুর্গন্ধ কেন হয় সর্বপ্রথমে এর কারণ নির্ণয় করতে হয়। আর সেজন্য রোগের ইতিহাস জানতে হবে এবং মুখ ও দাঁত পরীক্ষা করতে হবে। শারীরিক কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুখের মধ্যস্থিত কারণই এর জন্য দায়ী, সুতরাং এ ব্যাপারে মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

ভুক্তভোগীগণ নিম্নলিখিত পরামর্শ নিতে পারেন। যেমন-

১। সকালের নাস্তার পর এবং রাতে ঘুমোতে যাবার পূর্বে নিয়মিত দু'বেলা দাঁত মাজতে হবে।

২। দাঁতের মাঢ়ি, জিহ্বা কিংবা গলায় কোনও ক্ষত থাকলে তা অতিসত্বর চিকিৎসা করাতে হবে।

৩। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাউথ ওয়াশ দিয়ে কুলি করতে হবে।

৪ । ধুমপান করা ও মদ্যপান করা বর্জন করতে হবে।

৫ । পাথর, প্ল্যাক দাঁতের গোড়ায় জমলে তা পরিষ্কার করতে হবে।

৬। দীর্ঘদিন যাবৎ যদি কাশি, গলাব্যথা ও বুক ব্যথা হয় তবে তার চিকিৎসা করতে হবে।

৭। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

৮। রোগাক্রান্ত দাঁতের চিকিৎসা করতে হবে।

৯। ভাঙ্গা দাঁত থাকলে তা তুলে ফেলতে হবে।

১০। মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।

১১। মাঝে মাঝে টক জাতীয় লজেন্স খাওয়া উচিত যাতে মুখের লালা নিঃসরণ ঠিক থাকে।

ঠোঁটের কোণে ঘাঃ

ছেলেমেয়ের ঠোঁটের কোণে ঘা সাধারণত অপুষ্টির লক্ষণ বোঝায়। তাই ঘা হলে ছেলেমেয়েদের ভিটামিন এবং প্রোটিন যুক্ত খাবার যেমন- দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, ফল ও শাক সব্জি খেতে দিতে হবে।

মুখের থ্রাশঃ

মুখের ভেতরে জিভের ওপরে দইয়ের মতো সাদা সাদা টুকরো প্রলেপ দেখা যায়। এটি ছত্রাক সংক্রমণের জন্য হয়ে থাকে। ছোট শিশুদের মধ্যে এবং কিছু এন্টিবায়োটিক বেশি পরিমাণে সেবন করার ফলে এরূপ হয়ে থাকে। এন্টবায়োটিক খাওয়া খুব জরুরী না হলে তা বন্ধ করে দিতে হবে। সাংঘাতিক অবস্থা হলে নিস্ট্যাটিন ব্যবহার করতে হবে।

জিহ্বার ওপরে সাদা পর্দা পড়াঃ

সাধারণত জ্বর হওয়ার পরে জিহ্বা ও টাকরার ওপরে সাদা পর্দা পড়ে। এটি গুরুতর কোনও কিছু নয়। অল্প গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে কুলকুচা করলে ভাল হয়ে যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url