অজ্ঞান বা অচৈতন্য হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
অজ্ঞান বা অচৈতন্য হওয়াঃ
মানব দেহের নার্ভাস সিস্টেম কোনও কারণে অতিরিক্ত উত্তেজিত হলে কিংবা কর্মহীন হয়ে পড়লেই অজ্ঞান বা শক্ বা অচৈতন্য অবস্থা ঘটে। রোগীর মধ্যে যখন অতি সামান্য জ্ঞান থাকে কিন্তু আচ্ছন্নভাব প্রবল থাকে তখন তাকে অর্ধ চৈতন্য অবস্থা বলে। রোগীর চেতনা যখন একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন তাকে পূর্ণ অচৈতন্য অবস্থা বা কোমা বলে। অর্ধ চৈতন্য অবস্থায় যখন রোগী থাকে তখন রোগী কিছু কিছু কথার উত্তর দেয়, আচ্ছন্ন অবস্থা কখনও কম থাকে কখনও বেশি থাকে। একটুখানি চেষ্টা করলেই রোগীর আচ্ছন্নভাব কমে যায়। রোগী যখন কোমা অবস্থায় চলে যায় তখন তার কোনও জ্ঞান থাকে না, দেহের কোনও অংশে আঘাত করলেও সাড়া পাওয়া যায় না।
কি কি কারণে রোগীর অজ্ঞান বা অচৈতন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়?
বিভিন্ন রোগের কারণেঃ বিভিন্ন রোগের জন্য রোগী অজ্ঞান বা অচৈতন্য হয়ে পড়ে। যেমন- মৃগী, হিস্টিরিয়া, হার্টের করোনারী কিংবা মস্তিষ্কের সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস্ ইত্যাদি রোগে। এছাড়াও টাইফয়েড, কলেরা, নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, ডায়াবেটিকের কোমা ইত্যাদি রোগের কারণে কোমার সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণেঃ সড়ক দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণ বেশি হলে, মাথায় কোনও ধরনের আঘাত প্রাপ্ত হলে, কোনও কারণে শ্বাসরোধ হলে কিংবা দুর্ঘটনায় প্রবল ভয় পেলেও অচৈতন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়।
বিষক্রিয়া ঘটলেঃ কেউ যদি মারাত্মক বিষ সেবন করে ফেললে, বেশি পরিমাণে মদ্যপান করলে কিংবা নেশা জাতীয় কোনও জিনিস যেমন- গাঁজা, আফিম ইত্যাদি বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেললে অচৈতন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়।
তাপমাত্রার কম বেশি হলেঃ সান স্ট্রোক, হিট স্ট্রোক কিংবা প্রবল শৈত্য প্রবাহের কারণে।
রোগীর অজ্ঞান বা অচৈতন্য বা শক্ অবস্থার লক্ষণ ও চিহ্নঃ
১। রোগী সম্পূর্ণভাবে অচৈতন্য কিংবা অৰ্ধ অচৈতন্য থাকবে।
২। রোগীর নাড়ীর গতি দুর্বল ও দ্রুত হয় এবং সেই সাথে রক্তচাপ কমে যায়।
৩। মুখ রক্তাভ ও উত্তপ্ত হয়ে মুখমন্ডল ও শরীরে ঘাম দেখা দেয়।
৪। শ্বাস প্রশ্বাস অনিয়মিত ও কষ্টকর হয়।
৫। হাত, পা ও মুখ ফ্যাকাসে দেখায়।
৬। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে প্যারালাইসিস অবস্থার মতো হয়ে যায়।
৭। রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
৮। এই অবস্থায় রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
হিস্টিরিয়া জনিত শকঃ
১। হিস্টিরিয়া হলে রোগী মুখ বিকৃত করে থাকে, দাঁত খিঁচতে থাকে এবং সেই সাথে হাত পা ছোঁড়ে।
২। হিস্টিরিয়া সম্পূর্ণভাবে মানসিক কারণে ঘটে থাকে।
৩। কখনও রোগী ভীষণভাবে হাত পা ছোঁড়ে এবং দাঁত খিঁচতে থাকে।
৪। হিস্টিরিয়া আরম্ভ হলে বেশ কিছু সময় ধরে চলতে থাকে।
৫। সাধারণত যে সব যুবতী মেয়েরা মানসিক সমস্যায় ভোগে এদের ক্ষেত্রে এই রকম ঘটে থাকে।
প্রাথমিক চিকিৎসার পদ্ধতিঃ
১। স্পেলিং সল্ট শুঁকতে দিতে হবে।
২। এসব ক্ষেত্রে রোগীর সাথে শক্ত আচরণ করতে হবে।
৩। সহানুভূতি থাকবে কিন্তু তা প্রকাশ করা যাবে না।
৪। রোগী সুস্থ না হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অতিরিক্ত মদ্যপান কিংবা নেশাজাতীয় কোনও জিনিসের কারণে অজ্ঞান বা শক্ হলেঃ
১। এই অবস্থায় রোগী ঠিকমত চলাফেরা করতে পারে।
২। রোগী অপ্রকৃতিস্থ থাকে।
৩। কথাবার্তায় অসংলগ্নতার প্রকাশ ঘটে।
৪ । অসৌজন্যসূচক আচরণ করে।
৫। কোনও অসংলগ্ন আচরণ করে থাকলে পরবর্তীতে আর তা মনে থাকে না।
৬। চলাফেরায় একটা এলোমেলো ভাব আসে।
৭। অচৈতন্য ভাব আসতে পারে।
প্রাথমিক চিকিৎসার পদ্ধতিঃ
১। মদ্যপান বেশি করলে বমি করাতে হবে।
২। অধিক নেশাগ্রস্থ হয়ে বিষক্রিয়া ঘটলে বিষক্রিয়ায় সাধারণ ফাস্ট-এড করতে হবে।
৩। অবস্থা বেগতিক দেখলে অতি দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
মৃগী রোগী অজ্ঞান হলেঃ
মৃগী রোগীকে দেখে সুস্থ মনে হলেও মৃগী রোগ থেকে ফিট পর্যন্ত হয়ে যায়। অনেকে সপ্তাহ, দিন, মাস কিংবা মাসের তফাতেও ফিট হয়ে যায়। জন্মের সময় যদি মগজের কোনও ক্ষতি হয়, শিশু অবস্থায় অধিক জ্বর কিংবা মগজে ফিতা কৃমির সিস্ট থেকেও মৃগী রোগ হয়। এটি কোনও ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি স্নায়ুমন্ডলীর রোগ। তবে পিতৃ কিংবা মাতৃকুলে এই রোগ থাকলে এই রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই রোগ হলে হঠাৎ অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যাবার পূর্বে রোগীর মাথা ঘুরতে থাকে, দৃষ্টি শক্তি অস্পষ্ট হয়ে মাথা ঝিম ঝিম করে ও কান ভোঁ ভোঁ করে, সমস্ত দেহে পেশীর সংকোচন হয়।
মৃগী রোগের লক্ষণ ও চিহ্নঃ
১। মৃগী রোগীর ঘাড় শক্ত হয়ে যায়।
২। কেউ কেউ এতে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে ভয়ানকভাবে হাত পা ছোঁড়ে।
৩। অনেক সময় রোগী মলমূত্র ত্যাগ করে ফেলে।
৪। জিভে কামড়ের আঘাত লেগে যায়।
৫। কখনও কখনও দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়।
৬। হাতের আঙ্গুল বেঁকে শক্ত হয়ে যায়।
৭। মুখমন্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করে।
৮। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে লক্ষণগুলো কমে আসে।
মৃগীর ফিট হলে কি করণীয়ঃ
১। রোগীর মাথায় মুখে ঠাণ্ডা পানি দিতে হবে।
২। এক টুকরো কাঠ কিংবা ঐ ধরনের কোনও জিনিস পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুড়ে দু'পাটি দাঁতের মাঝ বরাবর দিতে হবে যাতে জিহ্বার মধ্যে কামড় না পড়ে।
৩। রোগীকে আগুন, পানি এবং ধারালো জিনিস থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
৪ । ভীড় ঠেকাতে হবে যাতে অক্সিজেনের অভাব না হয়।
৫। রোগী যদি বমি করে ফেলে তবে মাথা একপাশে কাত করে দিতে হবে। যেন দম বন্ধ হয়ে না যায় এবং শ্বাসনালী পরিষ্কার থাকে।
৬। রোগীকে প্রচুর চিনি মিশিয়ে চা দিতে হবে।
৭। ফিটের পরবর্তী সময় শরীরে নিস্তেজ ভাব আসতে পারে। তাই ঐ সময়টা রোগীকে বিশ্রাম দিতে হবে।
সন্ন্যাস রোগঃ
১। এ রোগ একটি সত্যিকারের মারাত্মক রোগ।
২। নানাভাবে রোগী এ রোগের পূর্বলক্ষণ বুঝতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে রোগীর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
৩। সমস্ত শরীরে কাঁপুনির ভাব দেখা দেয়। ২/৩ মিনিট এ অবস্থা থাকার পর রোগী ঝিমিয়ে পড়ে।
৪ । অনেক সময় রোগী অচৈতন্য হয়ে পড়ে।
৫। জ্ঞান ফিরে আসতে অনেক সময় লাগে।
৬ । অনেক সময় রোগী মৃত্যুবরণও করতে পারে।
প্রাথমিক চিকিৎসার পদ্ধতিঃ
১। রোগীকে সুস্থভাবে শুইয়ে দিতে হবে।
২। এ অবস্থায় রোগীর যাতে শারীরিক কোনও কষ্ট না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
৩। অজ্ঞান অবস্থাতেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে এবং অক্সিজেন দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কোনও দুর্ঘটনার কারণে স্নায়বিক শক্ঃ
১। কোনও কারণে যদি দেহে গুরুতর আঘাত লাগে তবে দেহের মধ্যে রক্তপাত জনিত শক্ ঘটে।
২। অনেক সময় দুর্ঘটনার জন্য প্রবল ভয়ে মানসিক শক্ হতে পারে।
৩। মাথায় আঘাত লাগার কারণেও শক্ হতে পারে।
৪। দেহের অভ্যন্তরে রক্তপাতের দরুনও শক্ হতে পারে।
৫। অনেক সময় নিজে সামান্য আহত হলেও অন্যের আঘাত দেখে নার্ভাস হয়ে শক্ হতে পারে।
৬। রোগের বিষের কারণেও শকের সৃষ্টি হতে পারে। যাকে বলা যায় টক্সিক শক্।
৭। কাটা পোড়া ইত্যাদির কারণেও মানসিক আঘাতের জন্য শক্ হতে পারে।
স্নায়বিক শক প্রাপ্ত হলে তার লক্ষণঃ
১। রোগীর মাথা ঝিম্ ঝিম্ করে এবং তার নিজের দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
২। শ্বাস প্রশ্বাস অনিয়মিত ও ক্ষীণ হয়।
৩। বমির ভাব কিংবা বমি হতেও পারে।
৪। রোগী মাঝে মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
৫। হাত পা শীতল হয়ে শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়।
৬। নাড়ী দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই ধরনের অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসার পদ্ধতিঃ
১। রোগীকে যথা সম্ভব সাহস যোগাতে হবে।
২। রোগীর কাপড় জামা ঢিলে করে দিতে হবে।
৩। রোগীকে সব সময় চিৎ করে শুইয়ে রাখতে হবে।
৪ । রক্তপাত হচ্ছে কি-না দেখতে হবে।
৫। পাল্স্ রেইট দেখতে হবে।
৬। জনতার ভীড় ঠেকাতে হবে।
৭। দেহের উত্তাপ কমে গেলে প্রয়োজনে চাদর কিংবা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
৮ । শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ থাকলে কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাস চালাতে হবে।
৯। রোগী জ্ঞান না হারালে এবং রক্তপাত না হলে গরম চা, কফি কিংবা দুধ খাওয়ানো যাবে।
১০। বেশি রক্তপাত হলে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
১১। দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
শক্ অবস্থায় কি কি করা অনুচিতঃ
১। অজ্ঞান থাকলে খাদ্য দেওয়া যাবে না।
২। রক্তপাত জনিত শকে খাদ্য দেওয়া যাবে না।
৩। উত্তেজক জিনিস দেওয়া যাবে না।
৪। বেশি কম্বল বা চাদর দিয়ে ঢেকে ঘামানো যাবে না।