পুড়ে গেলে করনীয় বা পুড়ে যাওয়ার চিকিৎসা
ত্বক সম্পর্কে কিছু কথাঃ
আমাদের জীবন রক্ষার্থে ত্বকের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ৩০% ত্বক নষ্ট হয়ে গেলে জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। আমাদের দেহের বহিরাবরণ এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ত্বকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পোড়াও এক ধরনের আঘাত। এতে ত্বকের মধ্যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পোড়ার ফলে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিকৃতি ঘটতে পারে। এর ফলে মানুষ অন্ধ ও বধির হয়ে যেতে পারে। সেজন্য পোড়া রোগীর চিকিৎসা অতিদ্রুত হওয়া উচিত।
আমাদের ত্বকের প্রধানত ২টি স্তর থাকে-
১। উপচর্ম ২। অন্তচর্ম।
উপচর্মের আবার ৪টি স্তর থাকে। ত্বকের বিভিন্ন কোষ, গ্রন্থি ও কলা থাকে।
তার মধ্যে প্রধানত হচ্ছে- ১। লোম, ২। লোমকূপ, ৩। ঘর্মগ্রন্থি, ৪ । তৈলগ্রন্থি,
৫। রক্তনালী, ৬। লসিকানালী, ৭। স্নায়ু।
পোড়া ২ প্রকার
১। পোড়া ২। ঝলসে যাওয়া।
পোড়ার কারণঃ
১। আগুনের মধ্যে পড়ে গেলে।
২। পরিধেয় বস্ত্রে আগুন লেগে গেলে।
৩। কোনও রাসায়নিক দ্রব্য- এসিড বা ক্ষার থেকে।
৪। ফুটন্ত তরল পদার্থ থেকে যেমন- তেল, পানি বা বাষ্প, আলকাতরা, পিচ প্রভৃতি ।
৫। বোমা বিস্ফোরণ হলে।
৬। ঘর বাড়ি কিংবা যানবাহনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে।
৭। দ্রুত ঘূর্ণনশীল বস্তু কিংবা ঘর্ষণের ফলে।
৮। উত্তপ্ত ধাতব পদার্থ দ্বারা ।
৯। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা জনিত কারণে।
লক্ষণঃ
প্রথমে দেহের চামড়া লাল হয়ে যায়। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় পোড়ার পরিমাণ ও গভীরতা সহজে নির্ণয় করা যায় না।
দেহের পোড়া অংশকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
১। ত্বকের বাহিরের অংশ পোড়া গেলে তাকে অগভীর পোড়া বলে।
২। ত্বকের সঙ্গে যদি মাংসপেশী পোড়া যায় তবে তাকে গভীর পোড়া বলে।
৩। দেহের ত্বকের আক্রান্ত অংশকে শতকরা হিসাবে ভাগ করা হয়। যেমন- শিশুদের ক্ষেত্রে ১০% পোড়া গেলেই গুরুতর পোড়া বলে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ১৫% পোড়া গেলে গুরুতর পোড়া বলে।
গভীর ও অগভীর পোড়ার লক্ষণ কিভাবে বুঝবেন?
যে সকল রোগী খুব বেশি পরিমাণে পোড়ে এদের ত্বকে জ্বালা ও বেদনার সৃষ্ট হয় এবং ত্বকের বহিরাবরণ উঠে গিয়ে শ্বেতবর্ণ ধারণ করতে পারে। এই সময় শরীরের তরল পদার্থ ক্ষতস্থান দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফলে রোগীর শক্ ও মৃত্যু হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
অগভীর পোড়ায় ত্বক লালবর্ণ হয়ে ফোস্কা পড়তে পারে। সেই সাথে জ্বালা ও ব্যথা হয়ে ফুলে যেতে পারে।
আগুনে পোড়া রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
১। আগুনে পোড়া রোগীকে প্রথমেই আগুন থেকে উদ্ধার করতে হবে। উদ্ধারকারীর নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তার নিজের জীবন যেন বিপন্ন না হয়।
২। পোড়া রোগীর পরিধেয় বস্ত্র যদি ত্বকের সাথে আটকে যায় তবে তা খোলার ব্যবস্থা করা উচিত নয়। তবে যদি এসিড কিংবা ক্ষার দ্বারা পোড়া যায় তবে তা সরিয়ে ফেলা উচিত। নচেৎ এতে করে এসিড কিংবা ক্ষার দ্বারা পোড়ার অংশ আরও বেড়ে যেতে পারে।
৩। পোড়া যদি খুব বেশি গভীর না হয় তাহলে জ্বালা ও বেদনা কমানোর জন্য ঠান্ডা পানিতে ১০/১২ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে ভাল হয়। এছাড়া বরফ পট্টি দেওয়া যেতে পারে। ভিনিগার দিয়ে ধুলেও জ্বালা যন্ত্রণা কমে যায়।
৪। কারও পরিধেয় বস্ত্রে যদি আগুন ধরে তবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ছুটাছুটি করতে না দিয়ে লেপ, কাঁথা কিংবা কম্বল দিয়ে জড়িয়ে ধরতে হবে। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কিংবা পানি ঢেলে দিলেও আগুন নিভে যায়। তবে পানি দিয়ে আগুন নেভাবার চেষ্টা না করাই উচিত। এতে করে ঘা বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
৫। পরিষ্কার কাপড়, গজ বা তুলা দিয়ে ব্যান্ডেজ করতে হবে, সংক্রমণ যাতে না ছড়াতে পারে এবং তরল পদার্থ শরীর থেকে বেশি বের না হতে পারে। সবচাইতে ভাল হয় পলিথিন দিয়ে যদি ক্ষতস্থান ঢেকে রাখা যায়।
৬। আমাদের গ্রাম দেশে পোড়া স্থানে ডিমের কুসুম, ছাই ইত্যাদি লাগানো হয়। কিন্তু এগুলো ক্ষতস্থানে লাগানো উচিত নয়।
৭। যদি কেরোসিন কিংবা পেট্রোলজনিত অগ্নিকান্ড ঘটে তবে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গেলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
৮। ফোস্কা পড়লে তা কখনও গালতে হয় না। এতে করে দেহের তরল পদার্থ বেরিয়ে যাবে এবং দেহে সংক্রমণ ঘটবে।
৯। শক্ প্রতিরোধ করতে হবে।
রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা পুড়ে যাওয়া রোগীর কি ব্যবস্থা করবেন?
রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা পোড়ার ঘটনা বিরল নয়। সাধারণত ল্যাবরেটরীতে কাজ করার সময় এ জাতীয় ঘটনা ঘটে থাকে। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে চেহারার বিকৃতি ঘটতে পারে। অন্ধ কিংবা বধির হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনাও বিরল নয়। দুষ্কৃতিকারীরা অস্ত্র হিসাবে এসিড কিংবা ক্ষারও ব্যবহার করে থাকে।
১। রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা যদি পুড়ে যায় তবে প্রথমেই প্রচুর পানি দ্বারা আক্রান্ত স্থান ধুতে হবে।
২। পরিধেয় বস্ত্র তাড়াতাড়ি খুলে ফেলে অন্য কোনও পরিষ্কার বস্ত্র দিয়ে দেহ ঢাকতে হবে।
৩। রোগীকে পানি দুধ ও অন্যান্য পানি জাতীয় তরল খাবার খেতে দিতে হবে।
৪। যত শীঘ্র সম্ভব হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
৫। চোখে লাগলে হাত দিয়ে চোখ না কচলে পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলতে হবে। খুব সাবধানে চোখ ধুতে হবে যেন মুখমন্ডলে কিংবা শরীরের অন্যস্থানে না লাগে। এরপর পরিষ্কার নরম কাপড় দিয়ে ড্রেসিং করে যতশীঘ্র সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।
আগুনে পোড়া কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
১। রান্নার পর চুলার আগুন নিভিয়ে ফেলতে হবে। কেরোসিনের চুলা ও স্টোভ কিংবা হিটারে সাবধানে রান্না- বান্না করতে হবে।
২। গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন মাঝে মধ্যে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
৩। গৃহে ও কলকারখানায় আগুন ও বিদ্যুতের ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।
৪। শিশুদেরকে আগুনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা উচিত।
৫। শিশুদেরকে কখনও আগুন কিংবা দিয়াশলাই নিয়ে খেলতে দেওয়া উচিত নয়।
৬। উত্তপ্ত তেলের কড়াইয়ে যদি আগুন ধরে যায় তবে পানি না দিয়ে ঢাকনা দিয়ে চাপ দিতে হবে।
৭। দিয়াশলাইয়ের কাঠি, বিড়ি সিগারেট থেকেও বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে। সুতরাং এগুলো যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না।
৮। ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, পানি গরম করার হিটার, ফ্রিজ ইত্যাদি সাবধানে ব্যবহার করতে হবে।
৯ । ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ, নর্দমা, কূপ ইত্যাদিতে গ্যাস ভর্তি থাকে, প্রজ্জলিত আগুন নিয়ে এসব কক্ষে প্রবেশ করা ঠিক নয়।
১০। ব্রিক ফিল্ডে ইট পোড়ানোর সময় খুব সতর্ক থাকা উচিত।
১১। আগুন থেকে উদ্ধারকারী দলকে কিভাবে উদ্ধার করতে হবে সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে নতুবা উদ্ধারকর্মীর নিজেরই জীবন বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে।