শেপার মেশিন কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
শেপার মেশিনঃ এটি ওয়ার্কশপে বহুল ব্যবহৃত মেশিন। এই মেশিনে সিঙ্গেল পয়েন্ট কাটিং টুল ব্যবহার করা হয়। কাটিং টুল সরলরৈখিক গতিতে ওয়ার্কপিচের উপর দিয়ে সামনে যাওয়ার সময় ধাতব পদার্থ অপসারণ করে। র্যাম পিছনে আসার সময় কাটে না। শেপারে কুইক রিটার্ণ মেকানিজম (quick return mechanism) কাজ করে অর্থাৎ র্যামের ফিরতি স্ট্রোকের গতি কাটিং স্ট্রোকের চেয়ে অনেক বেশি। কাটিং টুল্সের ওরিয়েন্টেশন অনুযায়ী আনুভূমিক, উল্লম্ব এবং কৌণিকভাবে অবস্থিত ওয়ার্কপিচের ধাতব পদার্থ অপসারণ করে। অপারেটর দক্ষ হলে টুল ফিড এবং টেবিল এডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে বাঁকা (curved) পৃষ্ঠের উপরও মেশিনিংয়ের কাজ করা যায়।
শেপার মেশিনের বিভিন্ন অংশের নাম বা শেপার মেশিনের প্রধান প্রধান অংশ সমূহঃ
১. বেস বা ভিত্তি (Base)
২. কলাম (Column)
৩. ক্রস রেল (Cross rail)
৪. টেবিল (Table)
৫. ড্রাইভিং পুলি (Driving pulley)
৬. ক্রস ফিড (Cross feed)
৭. র্যাম (Ram)
৮. টুল হেড(Tool head)
৯. টুল পোষ্ট (Tool post)
১০. এলিভেটিং স্কু (Elevating screw)
১১. ফিড ডিস্ক (Feed disk)
১২. ক্রস ফিড স্ক্রু (Cross feed screw)
১৩. ক্ল্যাপার বক্স (Clapper box)
১৪. অন/অফ সুইচ (On/off switch)
১৫. ফিড হ্যান্ড হুইল (Feed hand wheel)
১৬। স্যাডল (Saddle)
১৬। পাওয়ার ট্রান্সমিশন (Power transmission)
১৭। শেপার হেড (Shaper head) ইত্যাদি।
শেপার মেশিনের কাজঃ
শেপার মেশিনের সাহায্যে নিম্নরূপ কাজ করা যায়। যেমন-
১। কৌণিক তল শেপিং
২। ডাভটেইল শেপিং
৩। স্লট শেপিং
৪। কী-ওয়ে শেপিং
৫। গ্রুভ শেপিং
৬। কনভেক ও কনভেক্স তল শেপিং
৭। অনুভূমিক তল শেপিং
৮। উলম্ব তল শেপিং
৯। স্লাইন শেপিং ইত্যাদি।
শেপার মেশিন প্রধানত কি কাজে ব্যবহৃত হয়?
মেশিন শপের একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হল শেপার মেশিন। প্রধানত সমতল পৃষ্ট কাটার জন্য শেপার মেশিন ব্যবহার করা হয়। কোন ধাতুর পৃষ্টতল হতে অপ্রজনীয় অংশ কেটে ফেলে নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি প্রদান করাই শেপার মেশিনের প্রধান কাজ। এর মাধ্যমে কোন ধাতব বস্তুর তল কেটে প্রয়োজন মত আকার-আকৃতি প্রদান করা হয়। শেপার মেশিন দিয়ে বিভিন্ন রকম তল কাটার জন্য বিভিন্ন রকমের কাটিং টুল ব্যবহার করা হয়।
শেপার মেশিনের শ্রেনীবিভাগঃ
র্যাম চলাচলের মেকানিজম অনুযায়ী (Based on mechanism of ram movement) ৩ (তিন) প্রকার। যথাঃ
১. ক্র্যাঙ্ক টাইপ (Crank type): এটি একটি সাধারণ শেপার মেশিন যার র্যাম ক্র্যাঙ্ক মেকানিজমে রেসিপ্রোকেটিং মুভমেন্ট করে।
২. গিয়ারড বা গিয়ার্ড টাইপ (Geared type): র্যামটি রেক ও পিনিয়নে রেসিপ্রোকেটিং মুভমেন্ট করে। এ ধরনের শেপার মেশিন খুব কম ব্যবহারিত হয়।
৩. হাইড্রোলিক টাইপ (Hydraulic type): র্যামটি হাইড্রোলিক ওয়েলের চাপে রেসিপ্রোকেটিং মুভমেন্ট করে। অতি উচ্চ চাপে সিলিন্ডারে তৈল প্রবেশ করানো হয় এবং পিস্টন র্যামের সাথে সংযোগ থাকে। এই মেশিনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাটিং স্পীড ও র্যামের শক্তি একই থাকে।
পজিশন এবং ট্রাভেল অনুযায়ী ৩ (তিন) প্রকার। যথাঃ
১. আনুভূমিক টাইপ (Horizontal type): র্যাম আনুভূমিক বরাবর চলাচল করে। এই মেশিন সাধারণত ফ্যাট সারফেস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
২. ভার্টিকেল টাইপ (Vertical type): র্যাম উলম্ভ বরাবর চলাচল করে। কোনো মেশিনে র্যামকে উলম্ভ অক্ষের সাথে বিভিন্ন কোণে সেট করা যায়। এই মেশিন ক্র্যাঙ্ক, স্ক্রু এবং হাইড্রোলিক শক্তি দিয়ে চালিত হতে পারে।
৩. ট্রাভেলিং হেড টাইপ (Traveling head type): র্যাম একই সাথে কোণাকোণি চলাচল করে প্রয়োজনীয় ফিড দেয়। যেসব ভারী জব স্ট্যান্ডার্ড শেপারে সহজে বাঁধা যায় না সেগুলো এই মেশিনে শেপিং করা হয়।
টেবিলের ডিজাইন (Design of table) অনুযায়ী ২ (দুই) প্রকার। যথাঃ
১. স্ট্যান্ডার্ড বা প্লেইন শেপার (Standard or plain shaper): টেবিল দুই দিকে অর্থ্যাৎ আনুভূমিক বা উলম্ব বরাবর চলাচলের মাধ্যমে ফিড দেয়া হয়।
২. ইউনিভার্সাল শেপার (Universal shaper): স্ট্যান্ডার্ড শেপারের মত টেবিলটি আনুভূমিক ও উলম্ব বরাবর চলাচলের পাশাপাশি র্যামের অক্ষের কৌণিক অবস্থানে সেট করা যায়। যার ফলে জবকে বিভিন্ন তলে সেট করা যায়। জবকে যেকোন ভাবে সেট করা যায় বিধায় ইহাকে ইউনিভার্সাল শেপার বলে।
কাটিং স্ট্রোক অনুযায়ী ২ (দুই) প্রকার। যথাঃ
১. পুশ টাইপ (Push type): এটি একটি সাধারণ পদ্ধতি। কলাম থেকে র্যাম সামনে যাওয়ার সময় জব থেকে ধাতব পদার্থ অপসারণ করে এবং র্যাম কলামের দিকে সরে যাওয়ার পর জব মুভ করে।
২. ড্র টাইপ(Draw type): কলামের দিকে র্যাম যাওয়ার সময় জব থেকে ধাতব পদার্থ অপসারণ করে। স্ট্যান্ডার্ড শেপারে কাটিং টুল যেভাবে থাকে তার বিপরীতে বসাতে হয়। কাটার সময় এই মেশিনে ঝাঁকুনি কম লাগে এবং বেশি গভীরে কাট দিতে পারে।
কাটিং টুলের মেটেরিয়াল (Cutting tool material):
হাইস্পিড স্টিল (high speed steel) দিয়ে কাটিং টুল তৈরি করা হয়। হাইস্পিড স্টিল দিয়ে বেশির ভাগ টুল তৈরি করা হয়। ড্রিল, লেদ, প্লেনার, শেপার, মিলিং কাটার, রিমার, থ্রেডিং ডাইস এবং পাঞ্চে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এতে শতকরা ১৮ ভাগ ট্যাংস্টেন (tungsten), চার ভাগ ক্রোমিয়াম (chromium) এবং এক ভাগ ভ্যানাডিয়াম (vanadium) থাকে বেশি শক্ত মেটেরিয়ালে কাজের জন্য ট্যাংস্টেন কার্বাইড টুল ব্যবহার করতে হবে।
নিরাপত্তা ও সতর্কতা (Safety and precaution):
● নিরাপত্তা চশমা, হ্যান্ড গ্লোভ্স এবং জুতা পরে কাজ করতে হবে।
● সঠিক টুল্স নির্বাচন করতে হবে।
● সঠিক গতি এবং ফিড দিতে হবে।
● র্যামের সামনে দাঁড়ানো যাবে না।
● র্যাম চলার সময় স্ট্রোকের সমান্তরালভাবে দাঁড়াতে হবে।
● চলন্ত অবস্থায় টুল ও ক্ল্যাপার বক্স (clapper box) ছোঁয়া যাবে না।
● মেশিন বন্ধ অবস্থায় জবের মাপ নিতে হবে।
● মেশিন বন্ধ করে স্ট্রোক সমন্বয় করতে হবে।
● মেশিন চালু রেখে কোথাও যাওয়া যাবে না।
● কাজ শেষে মেশিন বন্ধ করতে হবে।
● মেশিন বন্ধ করে পরিস্কার করতে হবে।
শেপার মেশিনের সুবিধা ও অসুবিধা সমূহঃ
সুবিধা (Advantage):
● জবকে সহজে এবং দ্রুত বাঁধা যায়।
● মেশিন খুব সহজে সেট আপ করা যায় এবং দ্রুত এক জব থেকে অন্য জবে স্থানান্তর করা যায়।
● সিঙ্গেল পয়েন্ট কাটিং টুল দামে সস্তা এবং গ্রাইন্ডিং মেশিনে ধার দেয়া যায়।
● কম শক্তি প্রয়োগে ধাতব পদার্থ কাটে বিধায় পাতলা (thin) এবং ভঙ্গুর (brittle) জবেও কাজ করা যায়।
● ক্রাঙ্ক মেকানিজমের জন্য আইড্ল (idle) স্ট্রোকে সময় কম লাগে।
অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা (Disadvantage or Limitations):
● র্যাম এবং স্ট্রোকের সীমাবদ্ধতার কারণে বড় আকারের জবে ফ্লাট সারফেস তৈরি করার জন্য অনুপযোগী।
● সিঙ্গেল পয়েন্ট কাটিং টুল ব্যবহারের কারণে কাজ শেষ করার জন্য অনেকগুলো স্ট্রোক দিতে হয় এবং র্যামের ফিরতি স্ট্রোকে ধাতব পদার্থ অপসারণ করে না বিধায় কাজ সম্পন্ন করতে অনেক সময় লাগে।
● কাটার গতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
● রেসিপ্রকেটিং গতিতে (reciprocating) কাজ করে বিধায় মেশিনে অনেক ঝাঁকুনি তৈরি হয়।
শেপার মেশিন চালনা কৌশল (Operational procedure):
● চালনার আগে দেখতে হবে টুল, টুল হেড, টেবিল এবং সাপোর্টিং জিনিস যেন সঠিক অবস্থায় থাকে।
● মেশিনের র্যামে অবস্থিত টুল পোস্টে কাটিং টুল বাঁধতে হবে।
● টেবিলের উচ্চতা সমন্বয় করে ওয়ার্কপিচকে ভাইসে শক্ত করে বাঁধতে হবে। যাতে টেবিলকে পাশে ঘুরানো যায়। হাতের শক্তি দিয়ে টেবিলের উচ্চতা এবং পাশ সমন্বয় করা যায়।
● র্যাম প্রতি স্ট্রোকে কতদূর যাবে সেটা সমন্বয় করতে হবে। চার্ট দেখে গিয়ার সমন্বয় করে র্যামের গতি নির্ধারণ করতে হবে।
● মেশিনের সার্কিট ব্রেকার অন করতে হবে।
● মেশিনের সুইচ অন করতে হবে।
● মেশিনের র্যাম টু এন্ড ফ্রো (to and fro) গতিতে চলাচল করবে।
● হাত দিয়ে টেবিলকে সরিয়ে জবকে কাটিং টুলের কাছে আনতে হবে।
● মেটেরিয়ালের ধরন অনুযায়ী ফিড ও কাটার গভীরতা ঠিক করতে হবে।
● মেশিনের ফিডকে এনগেইজ (engage) করতে হবে।
● হাতে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেবিলের ফিড দেয়া যায়।
● টেবিলের ফিড সমন্বয় করে স্বয়ংক্রিয় নবে (knob) চাপ দিতে হবে।
● কাটিং টুল সরলরৈখিক গতিতে ওয়ার্কপিচের উপর দিয়ে চলাচলের মাধ্যমে ধাতু অপসারণ করবে।
● র্যাম সামনে যাওয়ার সময় ধাতব পদার্থ অপসারণ করবে।
● র্যাম পিছনে আসার সময় কাটে না।
● র্যামের গতি কাটার স্ট্রোকের চেয়ে ফিরতি স্ট্রোকে বেশি।
● ধাতব পদার্থ অপসারণের কাজ শেষ হলে ফিড এবং স্ট্রোক ডিজএনগেইজ (disengage) করতে হবে।
● মেশিনের সুইচ বন্ধ করতে হবে।
● ভাইস থেকে জবকে খুলতে হবে।
স্কয়ার শেপ তৈরী করাঃ
সবার আগে ভাইসটি টেবিলের উপর এমনভাবে বসাতে হবে যেন এর দাতগুলো র্যাম এর স্ট্রোকের সমান্তরাল থাকে। তারপর জবটি ভাইসের মধ্যে বসানো যাবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পুরূত্বে কাটা যাবে। পরবর্তীতে জব টিকে ঘুরিয়ে বসাতে হবে যাতে ফিনিসিং করা পাশটি দাতের বিপরীত দিকে থাকে এবং জবটিকে প্রয়োজনীয় প্রস্থে কাটতে হবে। তারপর ভাইসকে ৯০ ডিগ্রি এ্যাঙ্গেলে ঘুরাতে হবে দাতগুলো র্যাম এর স্ট্রোকের উলম্ব ভাবে অবস্থান করে। এবং জবকে ভাইসের একপাশে এমনভাবে বসাতে হবে যেন, জবের যে দিকটা কাটতে হবে সেটি ভাইসের দাতের খুব কাছাকাছি থাকে। ভাইসের অন্য পাশে আরেকটি সম-পুরুত্বের জিনিস দ্বারা আটকে রাখতে হবে যাতে ভাইস এর দাত গুলো সমান্তরাল থাকে।
আরও পড়ুনঃ সিএনসি মেশিন কি? সিএনসি মেশিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
”ভি” আকারের টুকরো তৈরী করাঃ
নিখুতভাবে একটি ”ভি” আকৃতির শেপ পেতে ভাইসের দাতগুলোকে র্যামের স্ট্রোকের সমান্তরালে সেট করতে হবে। কাটিং টুলসকে প্রয়োজনীয় এ্যাঙ্গেলে সেট করে লে-আউট করা দাগ বরাবর একটি রাফ কাট নিতে হবে। তারপর ”ভি” এর সাইড বরাবর কাটতে হবে। জব কি ভাইসের মধ্যে ঘুরিয়ে দিতে হবে। টেবিলের একই অবস্থানে রেখে, উল্টা দিকেও কাটতে হবে। এভাবে চালিয়ে যেতে হবে চাহিদা অনুযায়ী গভীরতা পাওয়া পর্যন্ত।
আরও পড়ুনঃ মিলিং মেশিন কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
শেপার মেশিন এবং প্লেনার মেশিনের মধ্যে পার্থক্যঃ
নং | শেপার মেশিন | প্লেনার মেশিন |
---|---|---|
১ | শেপার মেশিনে কার্যবস্তু কাটার স্থির থাকে এবং যাতায়াত করে থাকে। | প্লেনার মেশিনে কার্যবস্তু গতিশীল থাকে এবং কাটার স্থির থাকে। |
২ | অধিকাংশ শেপারে একটি মাত্র টুল পোস্ট থাকে। | প্লেনারে এক বা একাধিক টুল পোস্ট থাকতে পারে। |
৩ | শেপারের টেবিল উপরে, নিচে বা আশেপাশে সরানো যায়। | এর টেবিল উপরে-নিচে উঠানামা করা যায় না। |
৪ | অল্প দক্ষ কারিগর এই মেশিন অপারেট করতে পারে। | প্লেনার মেশিন চালাতে দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন হয়। |
৫ | শেপার মেশিনের কাটিং টুল ছোট ও হালকা। | প্লেনার মেশিনের কাটিং টুল বড় ও ভারী। |
৬ | শেপার মেশিন ছোট ও হালকা। | প্লেনার মেশিন বড় মাপের ও ভারী। |
৭ | ইহা ছোট কাজে ব্যবহার করা হয়। | ইহা বড় কাজে ব্যবহৃত হয়। |
৮ | ইহা কম উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হয়। | ইহা বেশী উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হয়। |
৯ | কাটিং টুলের স্পীড কনষ্ট্যান্ট থাকে না। | কাটিং টুলের স্পীড কনষ্ট্যান্ট থাকে। |