শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি: কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার
অপুষ্টির শিকার হলে শিশুদের যেসব সমস্যা হতে পারেঃ
১। শিশুর বৃদ্ধি রোধ হয়।
২। শিশুর ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়।
৩। পেট ফুলে যায়।
৪। শরীর ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে।
৫। নোংরা খাবার খেতে ইচ্ছা হয়।
৬। অত্যন্ত রোগাটে দেখায়।
৭ । ফুর্তি চলে যায়।
৮। রাত কানা রোগ হতে পারে।
৯। শিশুর ঠোঁটের কোণে ঘা দেখা যায়।
১০। ঘন ঘন সর্দি এবং অন্য সংক্রমণও হয়।
শিশু বেশি অপুষ্টির শিকার হলেঃ
১। ওজন বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় কিংবা খুব কম বাড়ে।
২। চুল পড়ে পাতলা হয়ে যায়।
৩। কখনও দেখা যায় যে মুখ ও পা ফুলে গেছে।
৪। চোখের পানি শুকিয়ে যায়।
৫। মুখের ভেতরে ঘা হয়।
৬। মুখের মধ্যে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে, মুখের চামড়া উঠে ঘা-এর সৃষ্টি হয়।
৭। স্বাভাবিক ভাবে বুদ্ধি বাড়ে না।
৮। অন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
৯। হাসতে খেলতে ইচ্ছা হয় না।
শিশুর খাদ্য গ্রহণে কুসংস্কার থেকে অপুষ্টিঃ
জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সমাজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কুসংস্কার বলতে আমরা বুঝি এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা কিংবা দুষ্ট প্রথাকে। আবার যে বিশ্বাসের কোনও যুক্তি কিংবা ভিত্তি নেই একেও কুসংস্কার বলা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশের অনেকেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পুষ্টিকর খাদ্য না খেয়ে অপুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে থাকে। ফলে অতি সহজেই অপুষ্টির শিকার হয়ে পড়ে। খাদ্য বিষয়ে আমরা সকলেই কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণাকে মেনে চলে থাকি। সুশিক্ষার অভাবেই আমরা এই ধরনের যুক্তিহীন কুসংস্কারকে মেনে চলি, শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। যেমন- বর্মী মহিলারা শরীরে পানি আসার ভয়ে শাক সব্জি খায় না। মালদ্বীপের গর্ভবতী মহিলারা হাঁপানির ভয়ে মুরগীর মাংস খায় না। পাকিস্তানের গর্ভবতী মহিলারা পাকস্থলীতে ব্যথার ভয়ে আলু, ফুলকপি, শালগম ইত্যাদি খায় না। কামুকতা বৃদ্ধির ভয়ে সিরিয়ার শিশুদেরকে ডিম খেতে দেওয়া হয় না।
আবার এশিয়ার কিছু কিছু দেশে বুকের দুধ বিষাক্ত হওয়ার ভয়ে মায়েদেরকে মাংস খেতে দেওয়া হয় না। এরকম বিভিন্ন কুসংস্কারের সাথে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছি।
কুসংস্কার থেকে মুক্তি লাভের আশায় শিশুদের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
১। শৈশব কালে।
২। অসুস্থ হলে।
৩ । গর্ভাবস্থায়।
৪। প্রসবের পরে।
৫ । অন্যান্য অবস্থায়।
শিশুর শৈশবকালেঃ
আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। দারিদ্রতার চাইতেও এর একমাত্র কারণ হচ্ছে ভ্রান্ত ধারণা। শিশু জন্মের পর অধিকাংশ মা যে কাজটি করেন তা হচ্ছে শালদুধ (কলোস্ট্রাম) ফেলে দেন। তাদের ধারণা শালদুধ শিশুর হজম হবে না। কারণ এতে ভূত প্রেতের নজর লেগেছে। অথচ চিকিৎসকদের মতে শালদুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারী। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে। অনেকে আবার মনে করে থাকেন যে, জন্মের পর শিশুর মুখে মধু না দিলে শিশু মিষ্টভাষী হবে না। অথচ চিকিৎসকদের মতে শিশুর মুখে মধু দিলে শিশুর পেট খারাপ হতে পারে। শিশুর খাদ্যে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন শর্করা ও আমিষ জাতীয় খাদ্যের। অথচ অনেক মা-ই আছেন যারা মনে করে থাকেন ৭/৮ মাস বয়সে শিশুকে ভাত দিলে শিশুর পেট মোটা হবে। ডালে আমিষ থাকা সত্ত্বেও তারা মনে করেন ডাল খেলে শিশুর হজম হবে না এবং পেট মোটা হবে।
অথচ ৫/৬ মাস বয়স থেকে যদি শিশুকে সহায়ক খাবার না দেওয়া হয় তবে শিশুর বৃদ্ধি ব্যহত হবে। শিশুর জন্মের প্রথম দুই বছর শিশুর মস্তিষ্কের গঠন বৃদ্ধি পায়, তাই প্রথম দুই বছর শিশুকে ভাল করে খাওয়ালে মস্তিষ্কের গঠন উন্নত হয়। পরবর্তীতে শত খাওয়ালেও মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটবে না-শুধু শারীরিক বৃদ্ধি ছাড়া। বাঙালী অনেক মা-ই আছেন যারা কৃমি বৃদ্ধি পাবার ভয়ে শিশুকে মাছ খাওয়ান না। তারা বলে থাকেন, মাছ খেলে নাকি পেট বড় হয়ে যায়। এছাড়া শিশুকে কৃমির ভয়ে কলা, গুড় চিনি ইত্যাদি শর্করা জাতীয় খাবার থেকে বঞ্চিত করা হয়। অথচ এগুলোর কোনওটাই কৃমির জন্য দায়ী নয়।
শিশু অসুস্থ হলেঃ
অসুস্থ হলেও আমরা বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার মেনে চলি যা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। একজন সুস্থ ব্যক্তির তুলনায় একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তির বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হয়। অনেক মা আছেন যারা শিশুর ডায়রিয়া হলে শিশুকে পাতলা করে তৈরি বার্লি ছাড়া কিছুই খেতে দেন না। কিন্তু ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে পুষ্টিকর উপাদানগুলো বের হয়ে যায়। ফলে শিশুর পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। কেউ কেউ আবার শিশুর ডায়রিয়া হলে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন। শক্ত কিংবা আধা শক্ত খাবার দিতে চান না। আবার এমনও দেখা যায় শিশুর হাম বা জ্বর হলে আমিষ জাতীয় খাদ্য খেতে দেন না। এসব ভ্রান্ত ধারণা শিশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এতে করে শিশুরা মারাত্মক অপুষ্টির শিকার হয়। অনেকে মনে করেন শরীরে কোনও ক্ষত থাকলে টক জাতীয় ফল খেতে দেওয়া উচিত নয়। অথচ টক জাতীয় ফলে ভিটামিন ‘সি’ অধিক পরিমাণে থাকে এবং ক্ষত শুকোতে সহায়তা করে থাকে।
গর্ভাবস্থায়ঃ
আমাদের দেশে একান্নবর্তী পরিবারের মেয়েরা পুরুষের পরে অথবা সবার শেষে খাবার খেয়ে থাকেন। পারিবারিক বন্টনের এ অসম নীতির ফলে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ইত্যাদি পুষ্টিকর খাদ্যের অংশ থেকে মেয়েরা বঞ্চিত হয়। ফলে যদিও গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টিকর খাদ্য অধিক খাওয়া উচিত তারপরেও মায়েরা এসব খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে।
গর্ভবতী মায়েদের বাচ্চা বেশি বড় হলে প্রসবের সময় অসুবিধা হবে বিধায় তাকে কম খেতে দেওয়া হয়। এছাড়া আরও কিছু ভ্রান্ত ধারণা যেমন জোড়া কলা খেলে যমজ সন্তান হবে, খিরাই খেলে বাচ্চার শরীর ফাটা ফাটা হবে, হাঁসের ডিম খেলে গলার স্বর হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে হবে, এসব কারণে এগুলো গর্ভিণীকে খেতে দেওয়া হয় না। বাংলাদেশের দুটি উপজেলায় গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, ৬ঃ৩% মা মৃগেল মাছ খান না সন্তানের খিঁচুনি হবার ভয়ে। পেটের অসুখের ভয়ে ১৪ঃ১% মায়েরা পুঁটি মাছ খান না এবং ১২ঃ৫% মায়েরা বোয়াল মাছ খান না। ৯ঃ৪% মায়েরা গর্ভপাতের ভয়ে আনারস খান না। ভূতে ধরার ভয়ে ১০:৯% মা ডাল খান না। এসব কুসংস্কারের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ায় মায়েরা স্বাস্থ্যবান শিশু জন্ম দিতে পারেন না।
প্রসবের পরেঃ
গর্ভাবস্থায় মায়েরা যেমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে কিছু খাদ্য খান না, তেমনি প্রসূতি অবস্থাতেও তারা কিছু খাদ্য বর্জন করে থাকেন। আমাদের দেশে প্রসবের পর অনেক মাকে সূতিকা রোগে আক্রান্ত হবার ভয়ে ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, পুঁটি মাছ ইত্যাদি খেতে দেওয়া হয় না। এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে প্রসূতিকে শুধু মাত্র মরিচ ভর্তা দিয়ে ভাত দেওয়া হয় ঘা শুকোনোর জন্য। আবার দুধের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য কালোজিরার ভর্তা দেওয়া হয়। আবার নবজাতকের 'হাম' বা ‘মাসী পিসী’ হবার ভয়ে আমিষ জাতীয় খাদ্য দেওয়া হয় না। অনেক অঞ্চলে দেখা যায় প্রসবের পর দুই সপ্তাহ পর্যন্ত প্রসূতিকে কাঁচা কলার ভর্তা এবং পুরনো চালের জাউ ছাড়া কিছুই খেতে দেওয়া হয় না। ফলে মা পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয় সেই সাথে শিশুও বঞ্চিত হয়। কারণ শিশুরা মায়ের দুধ থেকেই পুষ্টিকর উপাদান পেয়ে থাকে। এসব কারণে প্রসূতিও দুর্বল হয়ে পড়েন এবং রক্তাল্পতায় ভুগে থাকেন। এমনকি প্রসবোত্তর রক্তস্রাব প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে প্রসূতির মৃত্যুও হতে পারে।
অন্যান্য অবস্থায়ঃ
এছাড়াও আমরা আরও বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার মেনে চলি। যেমন- অনেকে হজম হবে না এ ভয়ে বয়স্কদের দুধ খেতে দেয় না। কিন্তু দুধ বয়স্ক ও শিশু সবার জন্যই আদর্শ খাদ্য। আবার অনেক সময় পুরুষ মানুষের কলিজা ছোটবহয়ে যাবার ভয়ে ছেলেদেরকে মুরগীর কলিজা খেতে দেওয়া হয় না। অথচ কলিজায় প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে। আবার লিভারের ও মূত্রাশয়ের ক্ষতির সম্ভাবনায় বয়স্করা মাংস খান না। সুস্বাদু পনির একটি আমিষ, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার। অথচ অনেকেই কোষ্টকাঠিন্য ও হজমের ব্যাঘাতের জন্য পনির খান না। কিন্তু পনির খেলে হজমে ব্যাঘাত ঘটে না।
আমাদের দেশের জনগণ আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে এমনিতেও মাছ, মাংস ও ডিম খেতে পারেন না। তার ওপর যদি ভ্রান্ত ধারণা থাকে তবে পুষ্টিকর উপাদান থেকেই তারা বঞ্চিত হবেন।
প্রতিকারঃ
একটি দেশের অপুষ্টির জন্য যে কারণগুলো দায়ী তারমধ্যে একটি প্রধান কারণ হলো কুসংস্কার। এই কুসংস্কারগুলো মেনে চলার পেছনে কাজ করে অজ্ঞতা।সুতরাং এর প্রতিকারের জন্য অজ্ঞতা দূর করতে হবে।
শিশুদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুনঃ
১। ছেলেমেয়েদের সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাত মুখ ধোয়া, মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, খাওয়ার পূর্বে হাত ধোয়া, এবং খাবার নাড়াচাড়া করার পূর্বে হাত ধোয়া ইত্যাদি শেখাতে হবে।
২। ছেলেমেয়েদেরকে নিয়মিতভাবে গোসল করাবেন এবং প্রয়োজনে জামাকাপড় পাল্টে দেবেন।
৩। ছেলেমেয়েদেরকে নিয়মিত দাঁত মাজতে শেখাবেন। মিমি, চকলেট, মিষ্টি এগুলো বেশি খেতে দেবেন না।
৪। শিশুদের নখ ছোট করে কেটে দিন। খালি পায়ে শিশুদের হাঁটতে দেবেন না।
৫। ফুটিয়ে পানি পান করুন এবং পরিষ্কার পানি ব্যবহার করুন।
৬। যাদের ছোঁয়াচে রোগ আছে তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখুন।
৭। খোস, পাঁচড়া, দাদ, উকুন, ক্রিমি থাকলে এদের অতি সত্বর চিকিৎসা করাবেন।
৮। শিশুরা যাতে নোংরা জিনিস মুখে না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
জন্মগত ত্রুটি রোধ করুন এবং সুস্থ শিশুর জন্ম দিনঃ
আপনি যদি একটি সুস্থ ও সুন্দর শিশু চান তবে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলুন। আশা করি নিরাশ হবেন না।
১। গর্ভাবস্থায় যতটা সম্ভব ভাল খাবেন। যেমন- মাছ, ডিম, ফল, শাক সব্জি ইত্যাদি।
২। সাধারণ লবণের পরিবর্তে আয়োডিন যুক্ত লবণ খাবেন।
৩। গর্ভাবস্থায় কোনও রকম ধূমপান বা মদ্যপান করা যাবে না ।
৪। যতটা সম্ভব ওষুধ বাদ দিয়ে চলবেন। যে ওষুধগুলো গর্ভবতীর জন্য নিরাপদ সেগুলো ব্যবহার করবেন।
৫। একটির বেশি সন্তানের জন্মের সময় খুঁত থাকলে আর ছেলেমেয়ে জন্ম দেবেন না।
৬। ৩৫ বছর বয়সের পর আর সন্তান জন্ম দেবেন না।
আরও পড়ুনঃ গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা