মিলিং মেশিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
মিলিং মেশিন (Milling machine)
মিলিং প্রক্রিয়ায় কাটিং টুল অনেক গতিতে ঘুরে ওয়ার্কর্পিচ থেকে ধাতব পদার্থ অপসারণ করে। আরবরে (arbor) একইসাথে একাধিক টুল বাঁধা যায়। মিলিং মেশিনে ফ্লাট সারফেস, ভিতর ও বাহিরের থ্রেড ও গিয়ার তৈরি করা যায়। কার্যক্ষমতা বেশি হওয়ায় শেপারের বদলে মিলিং মেশিনে কাজ বেশি করা হয়।
আরও পড়ুনঃ লেদ মেশিন ও মিলিং মেশিনের মধ্যে পার্থক্য
মিলিং মেশিন প্রধান অংশ (Main parts of Milling machine):
● বেজ (Base)
● ভার্টিক্যাল পজিশনিং স্ক্রু (Vertical positioning screw)
● ভার্টিক্যাল নি ট্রাভার্স ক্রাঙ্ক (Vertical knee traverse crank)
● নি (Knee)
● ক্রস ফিড হ্যান্ড হুইল (Cross feed hand wheel)
● টেবিল (Table)
● আরবর সাপোর্ট (Arbor support)
● ওভারহ্যাঙ্গিং সাপোর্ট (Overhanging support)
● স্পিন্ডল (Spindle)
● কলাম (Column)
●টেবিল ট্রাভার্স হ্যান্ড হুইল (Table traverse hand wheel)
মিলিং মেশিনের ব্যবহার (Use of Milling machine):
এই মেশিন দিয়ে ফ্লাট সারফেস, ভিতর ও বাহিরের থ্রেড ও গিয়ার তৈরি করা যায়। এছাড়াও মিলিং মেশিনের সাহায্যে বিভিন্ন প্রকার তল মেশেনিং , ড্রিলিং ,রিমিং, গিয়ার মিলিং ,স্পাইরাল মিলিং ইত্যাদি অপারেশন গুলো সহজেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ লেদ মেশিন কি? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
মিলিং মেশিনের প্রকারভেদ (Types of milling machine):
টাইপ অনুযায়ী (Based on type):
● ভার্টিক্যাল পজিশনিং ক্রু
● ভার্টিক্যাল মিলিং মেশিন (Vertical milling machine)
● হরাইজন্টাল মিলিং মেশিন (Horizontal milling machine)
● ইউনিভার্সাল মিলিং মেশিন (Universal milling machine)
● কলাম-এন্ড-নি টাইপ মিলিং মেশিন (Column and knee type milling machine)
● বেড টাইপ মিলিং মেশিন (Bed type milling machine)
আরও পড়ুনঃ ওয়েল্ডিং কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
বিভিন্ন প্রকার মিলিং মেশিন (Different types of Milling machines):
হ্যান্ড মিলিং মেশিন (Hand milling machine):
হ্যান্ড মিলিং মেশিনটি ছোট আকৃতির এবং ওজনে হাল্কা। হাতে ফিড দিয়ে কোনো ছোট আকৃতির জব যেমন চাবির ঘাট ও স্ক্রুর স্লট তৈরি করা হয়।
জিগ মিলিং মেশিন (Jig milling machine):
এই মেশিনে অতিসূক্ষ্ম মাপের (০.০০২৫৪ মিলি) মান সম্পন্ন জব তৈরি করা যায়। টুল, ডাই, জিগ ও ফিক্চার মিলিং করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুনঃ ইলেকট্রোড কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
ডুপ্লেক্স মিলিং মেশিন (Duplex milling machine):
এই মেশিনের দুই পাশে দুটি স্পিন্ডল থাকে। কোনো জবে একসাথে দুই পাশে অথবা একসাথে দুটি জবে মিলিং করা যায়।
ট্রিপলেক্স মিলিং মেশিন (Triplex milling machine):
এই মেশিনে তিনটি স্পিন্ডল থাকে। এর একটি স্পিন্ডল জবের উপর থাকে। কোনো জবে একসাথে তিনটি মিলিং করা যায়।
প্রফাইলিং মিলিং মেশিন (Profiling milling machine):
এটি একটি ভার্টিক্যাল মিলিং মেশিন। এই মেশিন দিয়ে অসম প্রোফাইলে মিলিং করা হয়।
আরও পড়ুনঃ শেপার মেশিন কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
থ্রেড মিলিং মেশিন (Thread milling machine):
ফর্মড মিলিং কাটার ব্যবহার করে পূর্ণ গভীরতায় এক বারে (one pass) থ্রেড কাটা যায়।
ইউনিভার্সাল মিলিং মেশিন (Universal milling machine):
ইউনিভার্সাল মিলিং মেশিন উল্লম্ব, আনুভূমিক এবং উভয় প্রকারের হয়। এটি সাধারণ মিলিং মেশিন থেকে অনেক জটিল ধরনের মেশিন। এই মেশিনের টেবিল আনুভূমিকভাবে বিভিন্ন কোণে সেট করা যায়। মিলিং
হেডকে আনুভূমিকভাবে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরানো যায় এবং উল্লম্বভাবে ৪৫ ডিগ্রি কোণে সেট করা যায়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের মিলিং করা যায়।
গিয়ার হবিং মেশিন (Gear hobbing machine):
এই মেশিন হব টুল (যার মধ্যে অনেকগুলো দাঁত থাকে) ব্যবহারের মাধ্যমে স্পার গিয়ার, ওয়ার্ম গিয়ার, হেলিক্যাল গিয়ার এবং স্ট্রোকেট কাটা যায়। এই মেশিনের সাহায্যে হব টুলের মাধ্যমে একসাথে একাধিক দাঁত কাটতে পারে বিধায় অন্য পদ্ধতি থেকে দ্রুত গিয়ার কাটা যায়।
মিলিং কাটার (Milling cutter):
ফেস মিল কাটার (Face mill cutter): কোনো জবের উপরিতল, কিনারা, গর্ত এবং স্টেপ্স থেকে ধাতব পদার্থ অপসারণ (ফেসিং) করার কাজে ব্যবহার করা হয়।
এন্ড মিল কাটার (End mill cutter): শেষ প্রান্ত ও পাশে কাটিং দাঁত থাকে। ফ্লাট ও কৌণিক ফেস, ওয়ার্কপিচের শোল্ডার, অভ্যন্তরীণ ও বহি:স্থ প্রফাইল মিলিং করা যায়।
স্লট ড্রিল (Slot drill): দুটো ফ্লুট থাকে যার মধ্য দিয়ে চিপ্স বের হয়ে আসে। কী-ওয়ে, স্লট মিলিং, কাউন্টার বোরিং, স্পট ফেসিং ও অসমতল সারফেসের ফ্লাট সিট (seat) মিলিং করা হয়।
রোলার এবং স্ল্যাব মিলিং কাটার (Roller and slab milling cutter): কাটারটি দেখতে রোলারের মতো। জবের উপরের পিঠে এবং সামান্য নিচু পিঠে মিলিং করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
সাইড এবং ফেস মিলিং কাটার (Side and face milling cutter): কাটারটি দেখতে ডিস্কের মতো। কাটারের পরিধি এবং পাশ বরাবর সারিবদ্ধভাবে দাঁত থাকে। কোনো জবের পাশ এবং উপরিতল মিলিং করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
স্লিটিং ‘স’ কাটার (Slitting saw cutter): ওয়ার্কপিচ কাটা, কর্ণার আন্ডার কাট করা এবং সরু স্লট তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই কাটারের পাশে (side) কাটিং দাঁত নেই।
স্লটিং কাটার (Slotting cutter): ওয়ার্কপিচে স্লট তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
এঙ্গেল কাটার (Angle cutter): কাটারে দাঁতগুলো বিভিন্ন কোণে যেমন একক কোণ (single angle), সমান কোণ (equal angle) ও দ্বৈত কোণে (double angle) তৈরি হয়।ওয়ার্কপিচের পাশে কৌণিকভাবে মিলিং, ভি-গ্রুপ কাটিং, চেস্ফারিং (chamfering) ও স্পাইরাল কাটিং করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
টি-স্লট কাটার (T-slot cutter): ওয়ার্কপিচ যেমন টুল টেবিল এবং অন্যান্য ওয়ার্কহোল্ডিং ডিভাইসে টি-স্লট কাটার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ডভটেইল কাটার (Dovetail cutter): ওয়ার্কপিচে স্লাইডিং ফিটের জন্য ডভটেইল গ্রুভ মিলিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়।
উডরাফ কিসিট কাটার (Woodruff keyseat cutter): ওয়ার্কপিচে চাবির ঘাট (keyseat), শ্যাফ্টে প্রিসিশন নচ (precision notch) ও স্লট (slot) তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ফ্লাই কাটার (Fly cutter): কাটারটি টুল সেন্টার থেকে অনেক দূরে থাকায় বেশ শক্তিশালী মেটাল দিয়ে তৈরি। দেখতে অনেকটা বোরিং টুলের মতো। সিঙ্গেল পয়েন্ট কাটারটি বড় আকারের ওয়ার্কপিচে এক বারে (one pass) ধাতব পদার্থ অপসারণ করে।
ফর্ম রিলিভড কাটার (Form relieved cutter): যে জব প্রোফাইল তৈরি করা হবে তার হুবহু আকৃতিতে কাটারটি প্রস্তুত করা হয়। দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক কন্টোর (contour) সারফেস তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
মিলিং মেশিন চালনা কৌশল (Operational procedure of Milling machine):
চালনা কৌশল জেনে মেশিন চালাতে হবে। নিরাপত্তা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সমস্ত ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশ পরিষ্কার করতে হবে এবং লুব্রিক্যান্ট দিতে হবে। মেশিন বন্ধ অবস্থায় এডজাস্টমেন্ট, পরিমাপ এবং পরিষ্কার করতে হবে। কুল্যান্ট সরবরাহ লাইন ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। সার্কিট ব্রেকার অন করতে হবে।
মেশিনের পাওয়ার সুইচ অন করে ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশ বিশেষ করে কাটার বারের ঘুর্ণন পরীক্ষা করতে হবে। কোথাও কোনো বাঁধা থাকলে দূর করতে হবে। জবকে ডিভাইডিং হেডে (dividing head) সেন্টারিং করে শক্ত করে বাঁধতে হবে।
নিচে ডিভাইডিং হেডের (dividing head) এর চিত্র দেওয়া হলোঃ
টেইলস্টক (tailstock) দিয়ে জবকে আটকাতে হবে। নিচে টেইলস্টক (tailstock) এর চিত্র দেওয়া হলোঃ
এর পর আরবরে কাঙ্ক্ষিত গিয়ার কাটার সেট করতে হবে। টেবিলকে উপর, নিচ এবং এদিকওদিক করে জবকে কাটার বার বরাবর সেন্টার করতে হবে। মেশিন চালু করে জবের উপর কাটার বারকে হাল্কাভাবে ছুঁতে হবে। এতে জবের উপরিভাগে একটি দাগ পড়বে। এই দাগকে কেন্দ্র করে জবে যে কয়টা দাঁত কাটতে হবে উপরিতলে সেই কয় ভাগে ভাগ করে দাগ কাটতে হবে। কাটার বারের গতি নির্ধারণ করতে হবে।
গিয়ারের দাঁত কাটার জন্য কম গতিতে কাটার বার চালাতে হবে। গিয়ার ফিনিসিংয়ের সময় কাটারকে বেশি গতিতে চালাতে হবে। এলুমিনিয়াম ও পিতলের ন্যায় নরম ধাতুতে গিয়ার কাটার সময় কাটার বারকে বেশি গতিতে চালাতে হবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিমাণমতো ফিড দিতে হবে। হাতেও ফিড দেয়া যাবে। বেশি ফিড দেয়া যাবে না। জবে কুল্যান্ট সরবরাহ করতে হবে। কাটিং ফ্লুইড ঠিকমতো পরিষ্কার করছে কিনা লক্ষ রাখতে হবে। একই ডেপ্থে সবগুলো গিয়ার কাটার পর কাটার গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
কাটার বারের ব্যাস এবং ধাতব পদার্থের গুণাগুণের উপর ডেপ্থ অফ কাট নির্ভর করে। একটি গিয়ার তৈরি করতে সাধারণত দুয়ের অধিকবার ডেপ্থ অফ কাট দিতে হবে। গিয়ার কাটা সম্পন্ন হলে দু'পাশে ফাইলিং করে ফিনিসিং করতে হবে। কাজ শেষে মেশিনের সুইচ বন্ধ করতে হবে। আরবর থেকে কাটার খুলে ভালোভাবে পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে। মেশিন পরিষ্কার করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ গ্রাইন্ডিং মেশিন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
মিলিং মেশিন চালনায় নিরাপত্তা ও সতর্কতা (Safety and precaution of Milling machine):
●জব প্রস্তুত পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।
● সব চালনা কৌশল জেনে মেশিন চালাতে হবে।
● জব ও মেটেরিয়ালের ধরন বুঝে সঠিক টাইপের মিলিং টুল নির্বাচন করতে হবে।
● কি ধরনের জব প্রস্তুত করতে হবে তা ভালোভাবে বুঝতে হবে।
● নিরাপত্তা জুতো ও চশমা পরে কাজ করতে হবে।
● হ্যান্ড গ্লোভ্স পরে কাজ করতে হবে।
● সমস্ত ঘূর্ণায়মান যন্ত্রাংশ পরিষ্কার করতে হবে এবং লুব্রিক্যান্ট দিতে হবে।
● সঠিক মাপের রেঞ্চ ব্যবহার করতে হবে।
● কুল্যান্ট সরবরাহ লাইন ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে।
● আরবরে সঠিক টাইপের মিলিং টুল বাঁধতে হবে।
● কাটারের ঘূর্ণন দিক ঠিক আছে কি না দেখতে হবে।
● কাটার বার পরিষ্কার করতে হবে।
● সম্ভব হলে কাটার গার্ড ব্যবহার করতে হবে।
● জবকে টেবিলে শক্ত করে বাঁধতে হবে।
● অনুমোদিত চার্ট দেখে গতি, ফিড এবং কাটার গভীরতা ঠিক করতে হবে।
● মেশিন বন্ধ করে কাটারের গতি এবং ফিড এডজাস্ট করতে হবে।
● ফিড এমনভাবে দিতে হবে যেন এক সময় টেবিল আরবরের সাথে ধাক্কা না খায়।
● কাটার গতি ও গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
● কাটার বার থেকে হাত ও কাপড়কে দূরে রাখতে হবে।
● কাটিং চিপ্স গরম ও তীক্ষ্ণ (sharp) হয়।
● খালি হাতে ছোঁয়া বা পরিষ্কার করা
যাবে না।
● চলন্ত অবস্থায় ওয়ার্কপিচে কোনো মাপ নেয়া যাবে না এবং কোনো এডজাস্টমেন্ট করা যাবে না।
● মেশিনের উপরে এবং টেবিলে কোনো টুল অথবা অন্য কিছু রাখা যাবে না।
● চলমান অবস্থায় মেশিনের কার্যক্ষেত্র ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়া যাবে না।
● কাজ শেষে সকল এডজাস্টমেন্ট ফ্রি করে দিতে হবে।
● মেশিন ও কর্মক্ষেত্র নিরাপদ এবং পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
● সমস্ত টুল্স পরিচ্ছন্ন করে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখতে হবে।
আরও পড়ুনঃ মিলিং মেশিন কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা