বিয়ারিং কাকে বলে? বিয়ারিং কত প্রকার ও কি কি? বিয়ারিং সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
সূচনা (Introduction):
শ্যাফট যার উপর প্রত্যক্ষভাবে ভর করে ঘোরে তাকে বিয়ারিং বলে। শ্যাফট ক্রমাগত ঘর্ষণের ফলে ক্ষয় হতে পারে। শ্যাফট ক্ষয় হয়ে গেলে তাকে বাতিল করে ঐ স্থলে নতুন শ্যাফট ব্যবহার করার ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য এবং অসুবিধাজনক।
বিয়ারিং (Bearing):
বিয়ারিং মেশিনের এমন একটি অংশ যা প্রধানত শ্যাফটকে অক্ষীয়ভাবে একটি অবস্থায় ধারণ করে ও সহজভাবে ঘুরতে সাহায্য করে, একে বিয়ারিং বলে। ঘূর্ণন বা অক্ষীয়ভাবে চলাচল করার মাধ্যমে শ্যাফটের প্রয়োগিক ভার বহন করার অপরিহার্য অংশকে বিয়ারিং বলে।
বিয়ারিং কত প্রকার ও কি কি?
বিয়ারিং মূলত দুই প্রকার। যথাঃ
ক) ঘর্ষণজনিত ( Frictional) বিয়ারিং বা ফ্রিকশন বিয়ারিং।
খ) অঘর্ষণ (Antifrictional) বা আবর্তন জনিত (Rolling) বিয়ারিং।
উভয় প্রকার বিয়ারিংকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
(ক) ঘর্ষণজনিত বিয়ারিং আবার তিন প্রকার। যথাঃ
১। জনার্ল বিয়ারিং (Journal Bearing)
২। ফুট স্টেপ বা পিভোট বিয়ারিং (Foot Step of Pivot Bearing)
৩। থ্রাস্ট বা কলার বিয়ারিং (Thurst or Collar Bearing)
খ) অঘর্ষণ জনিতে বিয়ারিং বলতে সাধারণত নিম্নের ছয় ধরনের বিয়ারিংকে বুঝানো হয়ে থাকে। যথাঃ
১। বুশ বিয়ারিং (Bush Bearing)
২। নিডল বিয়ারিং (Needle Bearing)
৩। বল বিয়ারিং (Ball Bearing)
৪ । থ্রাস্ট বিয়ারিং (Thrust Bearing)
৫। রোলার বিয়ারিং (Roller Bearing)
৬। টেপার রোলার বিয়ারিং (Tapper Roller Bearing)
বিভিন্ন বিয়ারিং-এর বিবরণ (Description of Different Types of Bearing) ঘর্ষণজনিত বিয়ারিং-এর বর্ণনাঃ
১। জনার্ল বিয়ারিং ( Journal Bearing): এ প্রকার বিয়ারিং-এর ক্ষেত্রে শ্যাফট ভূমির সাথে সমান্তারাল (Horizontally) থেকে ঘুরে থাকে এবং জর্নাল-এর অর্থাৎ এর উপর শ্যাফটের যে অংশ ভর করে ঐ চাপ বিয়ারিং শ্যাফটের অক্ষের সাথে ৯০ বা এক সমকোণ পড়ে। এটা সাধারণত ব্রোঞ্জ, ব্রাস, গ্রান মেটাল ইত্যাদি মিশ্র ধাতু দ্বারা তৈরি হয়ে থাকে এবং দুই খণ্ডে (Split) রকমের হয়। যে অংশের মধ্যে এটা বসানো হয়, থাকে হাউজিং (Housing) বলা হয়।
এটাও দু’খণ্ডে বিভক্ত। বিয়ারিংটির একটি খণ্ড উপর অংশের মধ্যে এটা বসানো হয়ে থাকে। হাউজিং নিচের অংশের সাথে যুক্ত করে নাট ও বোল্ট-এর দ্বারা অংশটি ভালোভাবে আবদ্ধ করা হয়ে থাকে। বিয়ারিংটি যাতে কোনো কারণে হাউজিং-এর মধ্যে ঘুরে না যায় বা দৈর্ঘ্যের দিকে সরে না যায় এর কারণে বিয়ারিংটির বহির্ভাগে বিভিন্ন আকারে খাঁজ ও উভয় প্রান্তে কলার করা থাকে।
এতে ঘষণজনিত বাধাকে কমানোর উদ্দেশ্য তেল প্রয়োগ করতে একটি অয়েল হোল (Oil Hole) বর্তমানে থাকে ও ভিতরের সমগ্র উপরিভাগে তেল সম্বলিত হতে কোণাকুণিভাবে তেল নালী (Oil Groove) করা থাকে।
২। ফুট স্টেপ বা পিভোট বিয়ারিং (Foot Step or Pivot Bearing): এ প্রকার বিয়ারিং-এ শ্যাফটের
প্রান্তভূমির সাথে লম্বভাবে (Vertically) ভর করে ঘুরতে থাকে এবং বিয়ারিং-এর চাপ, শ্যাফটের অক্ষের সমান্তরালভাবে পড়ে।
৩। থ্রাস্ট বা কলার বিয়ারিং (Thrust or Collar bearing): এ সকল বিয়ারিং-এ শ্যাফট ঘুরানোর সময় প্রান্তের দিকে চাপ অক্ষের সমান্তরালভাবে পড়ে ও কলার চাপকে প্রতিরোধ করে থাকে।
৪। বুশ বিয়ারিং ( Bush Bearring): সাধারণত বুশ বিয়ারিং ব্রাস (Brass) ফসফরাস ব্রোঞ্জ (Phosphoras bronze), গান মেটাল (Gum metal) প্রভৃতি মিশ্র ধাতু দ্বারা তৈরি করা হয়ে থাকে। এটা ঘর্ষণ সম্পর্কিত (Friction) অখণ্ড (Solid) রকমের এবং মধ্যস্থিত ছিদ্রটির মধ্যে যাতে শ্যাফট সহজভাবে ঘুরাতে পারে, এ জন্য ছিদ্রটি শ্যাফটের উপযোগী করতে রানিং ফিট নিয়মে সম্পন্ন করা থাকে।
হাউজিং (Housing)-এর মধ্যে বাইরের গোলাকার উপরিভাগে অর্থাৎ যে অংশের মধ্যে বিয়ারিংটি বসানো হবে এটা তাতে ড্রাইভিং নিয়মে আবদ্ধ করা থাকে। বুশ বিয়ারিংকে শ্যাফটের প্রান্তের দিক থেকে প্রবেশ করানো এক্ষেত্রে উপযোগী হয়।
(খ) অঘর্ষণজনিত বা আবর্তিত বিয়ারিং এর বর্ণনাঃ
১। বল বিয়ারিং (Ball Bearing): এই প্রকার বিয়ারিং বল দুটি রিং (Ring)-এর মধ্যে নির্দিষ্ট নালীতে অবস্থান করে আবর্তিত হয়। হাউজিং অংশের মধ্যে এটার বাইরের রিংটি যা নির্দিষ্ট জায়গায় দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে তাকে আউটার রেস (Outer Race) এবং ভিতরের রিংটি যা শ্যাফটের সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে তাকে ইনার রেস (Inner Race) বলে। বলের পয়েন্ট কন্ট্রাকের মাধ্যমে লোড ট্রান্সফার হয়। রোলিং রেজিস্ট্যান্স হয়।
২। রোলার বিয়ারিং (Roller Bearing): দুটি রেসের অন্তবর্তী অংশে রোলারগুলি পৃথককারী খাঁচা (Seperating cage)-এর মধ্যে থেকে সংযোগ রক্ষা করে। রোলগুলি রেসের সাথে সরল রেখা সূত্রে মিলিত হয়। ফলে বল বিয়ারিং অপেক্ষা রোলার বিয়ারিং বেশি ভার বহনে সমর্থ হয়। রোলার বিয়ারিং এ কোনো ঘর্ষণ যেন না হয় তার জন্য রোলিং রেজিস্ট্যান্স থাকে।
৩। নিডল বিয়ারিং (Needle Bearing): এটা অনেকটা রোলার বিয়ারিং-এর মতো। এর রোলার ব্যাস কম কিন্তু সংখ্যা অনেক বেশি। সাধারণত ছোট শ্যাফটের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা হয়।
৪। থ্রাস্ট রোলার বিয়ারিং (Thrust Roller Bearing): একে অনেক সময় টেপার রোলার বিয়ারিং ও বলে। এই বিয়ারিং একই সাথে অনুভূমিক এবং উল্লম্ব লোড বহন করতে পারে।
বিয়ারিং এর কাজ কি?
বিয়ারিং এর কাজ গুলো হলোঃ
১। লোড বহন করা।
২। শ্যাফট কে ঘুরতে সহায়তা করা ও শ্যাফটকে ধরে রাখা।
৩। ফ্রিকশন কে কমানো।
বিয়ারিং কেন ব্যবহার করা হয়?
বিয়ারিং ব্যবহারের মাধ্যমে চাকার বিভিন্ন তলের মধ্যবর্তী ঘর্ষণকে কমানো হয়।বেয়ারিং কোন যন্ত্রের গতিশীল অংশগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে বসানো থাকে। বেয়ারিংগুলোর ঘূর্ণনের ফলে যন্ত্রের গতিশীল অংশগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঘর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না। অর্থাৎ তলগুলো একটি অপরটির ওপর দিয়ে পিছলানোর পরিবর্তে গড়িয়ে যায় এবং ঘর্ষণ কমে যায়।
আরও পড়ুনঃপিস্টন কি? পিস্টন কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত জানুন
বিয়ারিং নাম্বার বের করার নিয়মঃ
বিয়ারিং নাম্বার (Bearing Number):
বিয়ারিং নাম্বার (Bearing Number) হচ্ছে এমন একটি সংখ্যার সিরিজ যা বিয়িারিং টাইপ, বিয়ারিং থিকনেস, বিয়ারিং এর আউটসাইড ডায়ামিটার এবং ইন্টারনাল ডায়ামিটার, ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি নির্দেশ করে। যেমন 6406 2Z C3 এখানে বিয়ারিং এর প্রথম সংখ্যা দ্বারা বিয়ারিং এর টাইপ বুঝায়। যেমন উপরে উল্লেখিত (6) দ্বারা ডিপ গ্রুভ বল বিয়ারিং (Deep Groove Ball Bearing) বুঝায়।
বিয়ারিং এর প্রথম সংখ্যা (1), (2), (3), (4), (5), (6), (7), (8) ইত্যাদি থাকলে নিম্নোক্ত বিয়ারিং টাইপ বুঝায়। যথাঃ-
(1) দ্বারা বুঝায়- Self Aligning Ball Bearing.
(2) দ্বারা বুঝায়- Barrel And Spherical Roller Bearing.
(3) দ্বারা বুঝায়- Tapered Roller Bearing.
(4) দ্বারা বুঝায়- Deep Groove Row Ball Bearing.
(5) দ্বারা বুঝায়- Axial Deep Groove Ball Bearing.
(6) দ্বারা বুঝায়- Deep Groove Ball Bearing.
(7) দ্বারা বুঝায়- Single Row Angular Contact Bearing.
(8) দ্বারা বুঝায়- Axial Cylindrical Roller Bearing.
বিয়ারিং নাম্বার এর দ্বিতীয় সংখ্যা দ্বারা বিয়ারিং এর সিরিজ বুঝায়। বিয়ারিং সিরিজ থেকে বিয়ারিং কেমন লোড বহন করবে ইত্যাদি জানা যায়। যেমন উপরে উল্লেখিত (4) দ্বারা বুঝায় বিয়ারিংটি 400 সিরিজ এর অর্থাৎ এটি হেভী লোড বহনে সক্ষম। বিয়ারিং নাম্বার এর দ্বিতীয় সংখ্যা (0,1), (2), (3), (4), (5) ইত্যাদি সংখ্যা থাকলে বুঝায়ঃ-
✓ 0,1 দ্বারা বুঝায় Extra Light.
✓ 2 দ্বারা বুঝায় Light
✓ 3 দ্বারা বুঝায় Medium
✓ 4 দ্বারা বুঝায় Heavy
✓ 5 দ্বারা বুঝায় Extra Heavy.
তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা দ্বারা বিয়ারিং এর বোর সাইজ বুঝায়। যেমনঃ-
উপরে উল্লেখিত (06) দ্বারা বুঝায় বিয়ারিংটির বোর সাইজ 30mm।
এখানে (00), (01), (02), (03) ব্যাতীত যে সংখ্যা থাকবে তাকে 5 দ্বারা গুণ করে যে মান পাওয়া যাবে তাই বিয়ারিং এর বোর সাইজ।
✓ বিয়ারিং নাম্বার এর তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা 00, 01, 02, 03 থাকলে বিয়ারিং এর বোর সাইজ 10mm বুঝায়।
✓ 01 থাকলে বিয়ারিং এর বোর সাইজ 12mm বুঝায়।
✓ 02 থাকলে বিয়ারিং এর বোর সাইজ 15mm বুঝায়।
✓ 03 থাকলে বিয়ারিং এর বোর সাইজ 17mm বুঝায়।
✓ উপরে উল্লেখিত বিয়ারিং নাম্বার এ (2Z) দ্বারা বুঝায় বিয়ারিং এর উভয় পাশে মেটাল সিল (Metal Seal) থাকবে।
✓ 2RS দ্বারা বুঝায বিয়ারিং এর উভয় পাশে রাবার সিল (Rubber Seal) দেওয়া।
✓ RS দ্বারা বুঝায বিয়ারিং এর এক পাশে রাবার (Rubber Seal) সিল দেওয়া।
✓ 2Z/ZZ দ্বারা বুঝায বিয়ারিং এর উভয় পাশে মেটাল সিল (Metal Seal) থাকবে।
✓ Z দ্বারা বুঝায বিয়ারিং এর এক পাশে মেটাল সিল (Metal Seal) থাকবে।
✓ E দ্বারা বুঝায বিয়ারিটি রিইনফোর্সড।
✓ K দ্বারা বুঝায বিয়ারিং এর বোর ট্যাপার (Tapper)।
✓ উপরে উল্লেখিত বিয়ারিং নাম্বার এ C3 দ্বারা বিয়ারিং এর ক্লিয়ারেন্স বুঝায়।
✓ CN দ্বারা বিয়ারিং এর নরমাল ক্লিয়ারেন্স বুঝায়।
✓ C1 দ্বারা বিয়ারিং এর ক্লিয়ারেন্স এর নরমাল ক্লিয়ারেন্স থেকে কম বুঝায়।
✓ C2 দ্বারা বিয়ারিং এর ক্লিয়ারেন্স C1 এর থেকে কম বুঝায়।
✓ C3 দ্বারা বিয়ারিং ক্লিয়ারেন্স এর নরমাল ক্লিয়ারেন্স থেকে বেশী বুঝায়।
বিয়ারিং এর প্রয়োজনীয়তা (Needs of Bearing):
নিম্নলিখিত কারণসমূহের জন্য বিয়ারিং এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। যথাঃ
১ । এটা ঘর্ষণজনিত বাধা (Frictional Registance) কে কমাতে উপযোগী হয়।
২। এটা শ্যাফটকে একই অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করে একে ঘুরতে সাহায্য করে।
৩। এটা মেশিনের হাউজিং অংশে সহজেই আবদ্ধ করা যায়।
৪ । এটা শ্যাফটকে ধারণ করে থাকে।
৫। এটা যে কোনো প্রকার ভার ও ঘর্ষণের ক্ষেত্রে উপযোগী হয়।
৬। এটা ব্যবহার করলে শ্যাফটের কোনোরূপ ক্ষতির আশংকা থাকে না।
উপরোক্ত কারণগুলি বিবেচনা করলে দেখা যায় বিয়ারিং এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অত্যাধিক। কারণ বিয়ারিং ছাড়া শ্যাফট ঘুরতে পারবে না ও পাওয়ার ট্রান্সমিট করতে পারবো না।
বিয়ারিং এ ব্যবহৃত লুব্রিকেন্টসমূহ (Bearing's Lubricants):
বিয়ারিং-এ ব্যবহৃত লুব্রিকেন্ট এর নাম নিচে দেওয়া হলোঃ
১। তেল (Oil)
২। গ্রীজ (Grase)
৩। এয়ার (Air )/গ্যাস ( Gass)
বিয়ারিয়ং এর যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (Care and Maintence of Bearing):
১। কাজ শেষে এটাতে প্রয়োজন মতো তেল জাতীয় পদার্থ দিয়ে রাখতে হয় যাতে মরিচা না পড়ে।
২। বিয়ারিং-এর উপর বেশি চাপ না পড়ে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। হাউজিং এ বিয়ারিং ক্যাপ শক্তভাবে ফিট থাকতে হবে।
৩। যে সকল মেশিনে বিভিন্ন প্রকার বিয়ারিং ফিট করা থাকে, মেশিন চালনা করার পূর্বে ঐ বিয়ারিংগুলোতে গ্রীজ, বা তেল জাতীয় দ্রব্য দিয়ে কাজ করতে হয়।
৪ । মেশিন কাজ করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে ঘর্ষণে বিয়ারিংগুলির তাপমাত্রা ৬০ সেন্টিগ্রেড থেকে ৭০ সেন্টিগ্রেডের বেশি না হয়।
৫। বিয়ারিং ক্লিয়ারেন্স চেক করে দেখতে হবে।
৬। লুব অয়েলের প্রকৃত ভিসকোসটি থাকতে হবে। পরিষ্কার এবং পরিমাণমতো থাকতে হবে।
আরও পড়ুনঃ যে লক্ষণে বুঝবেন গাড়ির ইঞ্জিন ভালো নেই