কিউপোলা চুল্লি কি? কিউপোলা চুল্লি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
কিউপোলা চুল্লির বর্ণনাঃ
ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে প্রাপ্ত পিগ লোহাকে লৌহ স্ক্রাপের সংঙ্গে মিশিয়ে পুনরায় যে চুল্লিতে গলিয়ে সস্তায় ঢালাই লোহা উৎপাদন করা হয়, তাকে কিউপোলা চুল্লি বলে। এটা প্রকৃত পক্ষে ব্লাষ্ট ফার্নেসের একটি ক্ষুদ্র পরিবর্তিত রূপ। এক চুল্লি হতে প্রাপ্ত লোহাকে পুনর্বার এই চুল্লিতে গলানো হয়। বলে একে রিমেন্টিং চুল্লি বলে।
কিউপোলা চুল্লির গঠনঃ
তাপ প্রতিরোধক পদার্থ ফায়ার ব্রিকের লাইনিং করা একটি খাড়া ইস্পাতের পাইপ-সদৃশ খোলক দ্বারা কিউপোলা চুল্লির বড়ি গঠিত। ১.৫ হতে ২ মিটার ব্যাসের ৯ হতে ১২ মিটার উচ্চ সাইজের কিউপোলা চুল্লি নির্মাণ করা হয়। ফার্নেসের ভিতরে কোক বেডে বাতাস প্রবেশ করনোর জন্য এর তলদেশের একটু উপরে ছিদ্র থাকে। ফার্নেসেটি সুবিধাজনক ফাঁকে স্থাপিত স্তম্ভের উপর অবলম্বন করা একটি বৃত্তকার প্লেটের উপর এমনভাবে বসানো থাকে যাতে কব্জাকৃত তলার দরজগুলি মুক্তভাবে ঘুরতে পারে।
কাজের সময় এই দরজাগুলিকে অনুভূমিকভাবে ঘুরিয়ে একটি খাড়া দণ্ডের সাহায্যে যথাস্থলে ধরে রাখা হয়। এছাড়া ফার্নেসের ভিতরে কাঁচামালসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদার্থ সরবরাহের জন্য দরজা থাকে। একে চার্জিং দরজা (Charging Door) বলে। তলদেশের ৪.৫ হতে ৭.৬ মিটার উপরে চার্জিং পদার্থ প্রবেশ করানো হয়। গলিত ধাতুকে যথাসময়ে ফার্নেস থেকে বের করার জন্য নিচের দিকে পাশে দরজা কাটা থাকে। একে ট্যাপ-হোল (Tap hole) বলে।
গলিত ধাতুর অপদ্রব এবং অন্যান্য পদার্থ হতে অপদ্ৰব মিশিয়ে যে হালকা ওজনের ধাতুমল উৎপন্ন হয় তা বের করার জন্য ট্যাপ-হোলের উপরে অপর পাশে স্নাগ-হোল থাকে। ফার্নেসের মাথার উপরে ছিদ্রযুক্ত একটি কভার থাকে একে স্পার্ক এরস্টার বলে। এই চুল্লির খোলক সাধারণত ৬.৩ মি.মি. পুরু বয়লার প্লেট দিয়ে তৈরি হয়।
কিউপোলা চুল্লির কার্যপ্রণালিঃ
প্রথমে ফার্নেসের তলায় অবস্থিত র্যামিং করা বালির উপর কোকের বেড চার্জ রাখা হয়। বেড় চার্জের উপর নির্দিষ্ট অনুপাতে লোহা ও কোক রাখা হয়। বিভিন্ন গলন-অনুপাতের কিউপোলা থাকে। যেমনঃ- ১০ঃ১ কিংবা ৮ঃ১ ভাগ লোহার সঙ্গে এক ভাগ কোক মিশাতে হবে।
চিত্রঃ কিউপোলা চুল্লি। |
এছাড়া উৎপন্ন ধাতু মলের প্রবাহিতা বাড়ানো এবং লোহার অক্সিজেন সংযোগ বন্ধ করার জন্য ফ্লাঙ্ক হিসাবে চুনাপাথর (Lime stone) ফোর স্পার (Fluorspar) বা সোডা-অ্যাশ (Soda-ash) যোগ করা হয়। প্রতি টন লোহার জন্য ৩৪ কেজি চুনাপাথর দরকার। প্রতি টন লোহা গলাতে সরবরাহকৃত বাতাসের পরিমাণ কোন এবং কোন-লোহার অনুপাতের নির্ভর করে।
তাত্ত্বিকভাবে এত কিলোগ্রাম কার্বন পোড়াতে ৬০০ ফাঃ তাপমাত্রায় ১ কেজি/বর্গ সেঃ মিটার চাপে প্রায় ৭ ঘন মিটার বাতাস প্রয়োজন। তবে সাধারণ হিসাবে এক কেজি কোক পোড়াতেই ৯.২৬ ঘন মিটার বাতাস প্রয়োজন। বেড চার্জ জ্বালানোর পরে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য চার্জ দেয়া হয়।
এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে, সরবরাহকৃত বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে দশ মিনিটের মধ্যে ট্যাপ-হোলে গলিতে ধাতু জড়ো হতে থাকে। এরপর ট্যাপ-হোল খুলে ল্যাডেলে গলিতে ধাতু সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় স্থানে ঢালাই করা হয়। একটি কিউপোলা চুল্লির সকল কাজকে নিম্নলিখিত ধাপে বিভিক্ত করা যায়। যথাঃ-
১। কিউপোলার ব্যবহার প্রস্তুতি।
২। কোক বেড আগুন জ্বালানো।
৩। কিউপোলাতে চার্জ সরবরাহ।
৪। ট্যাপিং।
বি. দ্র. স্যান্ড বেডের উপর নরম শুকনা কাঠ রেখে এর উপর টায়ার পর্যন্ত উচ্চতায় কোক রাখা হয়। তারপরই লেকট্রিক স্পার্ক ইগানইটার অথবা গ্যাস টর্সের সাহায্যে আগুন ধারানো হয়। কোক বেড়ের উচ্চতা মোটামুটি ৭৬ সে.মি.। চার্জিং দরজা হতে একটি চেইন বা রডের সাহায্যে কোক বেডের উচ্চতা মাপা যায়। কিউপোলাতে ধাতুর রিফাইনিং বা বিশোধন খুব সামান্য পরিমাণে হয়। গলনের সময় মোটমুটি ১০% সিলিকন, এবং ১৫-২০% ম্যাঙ্গানিজ জারণ ক্রিয়ার ফলে অপচয় হয় এবং ৩-৪% সালফার যুক্ত হয়।
কিউপোলা চুল্লির প্রধান প্রধান অংশ সমূহঃ
চিত্রঃ কিউপোলা চুল্লি। |
(ক) টাইয়ার্স (Tuyeres): কিউপোলা চুল্লির কোক বেডে বাতাস সরবরাহের জন্য এর দেয়ালের চারদিকে যে ছিদ্র রাখা হয়, তাকে টাইয়ার্স বলে।
(খ) ট্যাপ-হোল (Tap Hole): কিউপোলা হতে গলিত ধাতু ল্যাডেলে ঢালাই করার জন্য চুল্লিতে যে ছিদ্র পথ রাখা হয়, তাকে ট্যাপ-হোল বলে। এর বিপরীত দিকে সামান্য উপরে এবং টাইয়ার্স-এর একটু নিচে আর একটি ছিদ্র থাকে যা ধাতুমল বের করার জন্য ব্যবহৃত হয়। একে স্লাগ-হোল বলে।
(গ) কিউপোলা জোন (Cupola zone): একটি কিউপোলা চুল্লিকে মাথা হতে গোড়া পর্যন্ত একে কার্য প্রণালি মোতাবেক কয়েকটি ভাগে ভাগ করে প্রতি অংশকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়। এই বিভিন্ন অংশকে এক একটি বলয় বা জোন (এলাকা) বলে।
কিউপোলা চুল্লির জোনগুলি নিম্নরূপঃ
১। ওয়েল বা ক্রুসিবল জোন (Well or Crucible zone)
২। প্রজ্বলন জোন (Combustine zone)
৩। বিগলন জোন (Melting zone)
৪। পর্ব-তাপ জোন (Prehcating zone)
৫। রিডিউসিং জোন (Reducing zone)
৬। স্ট্যাক জোন (Stack zone)
আরও পড়ুনঃ ধাতু কাকে বলে? ধাতু কত প্রকার ও কি কি? ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
১। ওয়েল বা ক্রুসিবল জোন (Well or Crucible zone):
চুল্লিতে ধাতু গলিয়ে যাওয়ার পর নিচের দিকে চলে আসে এবং বেডের উপর জড়ো হতে থাকে। এখান হতে ট্যাপ-হোল বেয়ে ল্যাডেলে ধাতু ঢালাই করা হয়। স্যান্ড বেড এবং টাইয়ার্স-এর মধ্যবর্তী স্থানকে ওয়েব বলে। একে ক্রুসিবল জোনও বলা হয়।
২। প্রজ্বলন জোন (Combustine zone):
চুল্লির যে অংশে এয়ার চার্জ পুরাপুরিভাবে প্রজ্বলিত হয় ঐ অংশকে প্রজ্বলন জোন বলে। এই স্থানে চার্জের কার্বন, সিলিকন ও মাগানিজের অক্সিজেন সংযোগ (Oxidation) ঘটে। তাই একে অক্সিডাইজিং জোনও বলে। এই জোনে ১৫৫০°-১৮৭৫° সেঃ তাপমাত্রায় সৃষ্টি হয়।
৩। রিডিউসিং জোন (Reducing zone):
প্রজ্বলন জোনে সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড উপরের দিকে উঠে কার্বন মনোঅক্সাইড-এ পরিবর্তিত হয়। তাই প্রজ্বলন জোনের উপরের অংশকে রিডিউসিং জোন বলে। এই জোনকে সংরক্ষিত জোনও বলে (Protective zone)। কারণ বাতাস না যেতে পারলে চার্জে অক্সিজেন-সংযোগ হতে পারে না। এই জোনের তাপমাত্রা মোটামুটি ৩০০০° ফাঃ।
৪। বিগলন জোন (Melting zone):
চুল্লির যে অংশে চার্জের পুনর্গলন ক্রিয়া সম্পন্ন হয় তাকে মেল্টিং জোন বলে। এর নিচেই থাকে সুপারহিটিং জোন এবং উপরে থাকে প্রিহিটিং জোন। মোল্টিং জোনের তাপমাত্রা প্রায় ৩১০০° ফাঃ।
৫। প্রিহিটিং জোন (Preheating zone):
চুল্লির মেল্টিং জোন এবং স্ট্যাকের মধ্যবর্তী অংশকে প্রিহিটিং জোন বলে। এই জোনের চার্জের উপর গরম বাতাস সরবারাহ করে ধীরে ধীরে তাপ প্রদান শুরু হয়। এই জোনে ধাতু গলে না। এই জোনের ভিতরেই চার্জিং দরজা থাকে। প্রিহিটিং জোনের তাপমাত্রা ২০০০° ফাঃ।
৬। স্ট্যাক জোন (Stack zone):
চুল্লির মাথার উপর ঢাকনা বাদ দিয়ে নিচের প্রিহিটিং জোন পর্যন্ত অংশকে স্ট্যাক জোন বলে।
স্পার্ক এরস্টার (Spark Arrester):
চুল্লির ভিতরে গলনের সময় অগ্নিস্ফুলিংগসহ বিভিন্ন কণা যাতে চুলি-র উপর দিয়ে বের হতে না পারে, সে জন্য মাথার উপরে চুলি-র ব্রাসের চাইতে আকারে সামান্য বড় করে একটি সচ্ছিদ্র ঢাকনা ব্যবহৃত হয়। এতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গুলি বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে একে স্পার্ক এরেস্টার বলে।
কিউপোলা রেশিও (Cupola Ratio):
একটি কিউপেলা চুল্লিতে চার্জ হিসেবে ব্যবহৃত লোহা ও কোকের অনুপাতকে কিউপোলা রেশিও, ফুয়েল রেশিও বা মেল্টিং বলে। মেল্টিং রেশিও ১০ঃ১ বলতে বুঝায় দশ ভাগ লোহার সহিত একভাগ কোক মিশানো হয়েছে। একে অনেক সময় কোক লোহা অনুপাতও বলা হয়। ১০ঃ১ এর স্থলে একে ১ঃ১০ এভাবেও লেখা হয়। কম অংশই কোক বুঝতে হবে। এ লোহা-কার্বন অনুপাত নামেও পরিচিত । প্রাপ্ত জ্বালানির মান অনুসারে ৪ঃ১ হতে ১২ঃ১ অনুপাতে কিউপোলা রেশিও প্রচলিত।
আরও পড়ুনঃ সংকর ধাতু কী? সংকর ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
কিউপোলা চুল্লির দক্ষতা (Efficiency of cupola Furnace):
কিউপোলা চুল্লি বলতে এর তাপীয় দক্ষতা বা থার্মাল এফিসিয়েন্সি বুঝায়। একে আবার মেল্টিং দক্ষতাও বলে। কোকের তাপীয় পরিমাণ, অক্সিডেশনের তাপ এবং বাতাসের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য (Senslibie) তাপ এর সমষ্টির সহিত ধাতু গলানোর কাজে ব্যবহৃত তাপের অনুপাতের শতকরা হিসাবকে চুল্লির মেল্টিং দক্ষতা বলে। একটি কিউপোলার গলন দক্ষতা ৩০-৫০% হয়ে থাকে।
বি. দ্র. মেল্টিং সামর্থ্য, ব্যাস, পেটের গুরুত্ব, মোট উচ্চতা, টাইয়ার্স-এর সংখ্যা এবং রোয়ারের অশ্ব ক্ষমতা দ্বারা একটি কিউপোলা চুক্মির স্পোসিফিকেশন বুঝানো হয়।
কিউপোলা চুল্লির সুবিধা ও অসুবিধাঃ
নিচে কিউপোলা চুল্লির সুবিধা ও অসুবিধাগুলো দেওয়া হলোঃ-
কিউপোলা চুল্লির সুবিধাঃ
১। এর গঠন ও ডিজাইন খুব সরল।
২। অর্থনৈতিক দিক থেকে এর কার্য প্রণালি সস্তা।
৩। কম রক্ষণাবেক্ষণসহ অবিরাম কাজ করতে সক্ষম।
কিউপোলা চুল্লির অসুবিধাঃ
১। জ্বালানির সংস্পর্শে ধাতু গলানো হয় বলে কিছু অংশ নষ্ট হয়। সর্বশেষ বিশ্লেষণের এই অপচয় ধরা পড়ে।
২। কিউপোলার ভিতরে বিশেষ শ্রেণির লোহা ও সংকর ধাতুর নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর।
৩। সূক্ষ্ম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর।
৪। কম কার্বনের ঢালাই লোহা উৎপাদন কষ্টকর।
আরও পড়ুনঃ হার্ডেনিং কি? হার্ডেনিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা