সেল কি? সেল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
সেল কি?
যে যন্ত্রের সাহায্যে রাসায়নিক শক্তি হতে বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন করে বিদ্যুৎ প্রবাহ বজায় রাখা হয়, তাকে সেল বলে।
সেলে যতক্ষণ রাসায়নিক ক্রিয়া চলতে থাকে, ততক্ষণ বিদ্যুৎ প্রবাহ পাওয়া যায়। যেই মাত্র রাসায়নিক ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন সাথে সাথে বিদ্যুৎ প্রবাহও বন্ধ হয়ে যায়। সেলের সাংকেতিক চিহ্ন নিম্নরূপ-
চিত্রঃ সেলের সাংকেতিক চিহ্ন। |
আদর্শ সেলঃ
যে বিদ্যুৎ কোষের বিদ্যুৎ চালক বল সর্বদা একক থাকে এবং যার সাহায্যে অন্যান্য বিদ্যুৎ কোষের বিদ্যুৎ চালক বল তুলনা করা হয়, তাকে আদর্শ বিদ্যুৎ কোষ বলে।
সেল-এর গঠনঃ
ড্রাই সেলঃ
এটি ল্যাকলেন্স বিদ্যুৎ কোষের ভিন্ন রূপ। কোষে উত্তেজক হিসাবে NH₄Cl-এর পেস্ট এবং অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড নিবারক হিসাবে কঠিন MnO₂ ব্যবহৃত হয় বলে একে ড্রাই সেল বলে। একটি ড্রাই সেলের গঠন চিত্র অঙ্কন করা হলোঃ-
চিত্রঃ ড্রাই সেল। |
সেল-এর প্রকারভেদঃ
বিদ্যুৎ সেল প্রধানত দুই প্রকার। যথাঃ
(ক) প্রাইমারি সেল এবং
(খ) সেকেন্ডারি সেল।
প্রাইমারি সেলকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
(ক) এক তরল সেল এবং
(খ) দুই তরল সেল।
এক তরল সেলঃ
যে প্রাইমারি সেলে শুধু এক প্রকার তরল পদার্থ ব্যবহার করা হয়, তাকে এক তরল সেল বলে। যেমন-ড্রাইসেল, লেকল্যান্স সেল।
দুই তরল সেলঃ
যে সেলে দুই প্রকার তরল পদার্থ ব্যবহার করা হয়, তাকে দুই তরল সেল বলে। যথাঃ-
(ক) ডেনিয়েল সেল
(খ) বুনসেন সেল ইত্যাদি।
সেল-এর গ্রুপিংঃ
একাধিক সেলকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এক বর্তনীতে যুক্ত করার ব্যবস্থাকেই সেলের গ্রুপিং বা বিন্যাস বলে। এভাবে কয়েকটি সেল একত্রিত হয়ে একটি ব্যাটারি হিসাবে কাজ করে।
সেলের এ গ্রুপিং মূলত তিন প্রকার। যথাঃ
১। সিরিজ গ্রুপিং
২। প্যারালাল গ্রুপিং এবং
৩। মিশ্র গ্রুপিং ইত্যাদি।
সিরিজ গ্রুপিংঃ যে সমস্ত সেল সিরিজ গ্রুপিং করতে হবে, তাদের কারেন্ট রেটিং অবশ্যই সমান হতে হবে।প্রথম সেলের নেগেটিভ প্রান্তকে দ্বিতীয় সেলের পজেটিভ প্রান্তের সাথে এবং দ্বিতীয় সেলের নেগেটিভ প্রান্তকে তৃতীয় সেলের পজেটিভ প্রান্তের সাথে যুক্ত করতে হবে। অনুরূপভাবে চতুর্থ, পঞ্চম ইত্যাদি সমস্ত সেল পরস্পর যুক্ত করতে হবে।
সিরিজ গ্রুপিং-এর ফলে কারেন্ট রেটিং অপরিবর্তিত থাকে কিন্তু ভোল্টেজ রেটিং বৃদ্ধি পায় এবং গ্রুপিংযুক্ত সমস্ত সেলে ভোল্টেজের যোগফলের সমান হয়। নিচে তার সার্কিট চিত্র অঙ্কন করা হলোঃ-
চিত্রঃ সেল সিরিজ সংযোগ। |
এখানে,
V = V₁ + V₂+ V₃
V = মোট ভোল্টেজ।
V₁, V₂, V₃ = পৃথক পৃথক সেলের ভোল্টেজ।
I = I₁ = I₂ = I₃
I = মোট কারেন্ট।
I₁, I₂, I₃ = পৃথক পৃথক সেলের কারেন্ট।
প্যারালাল গ্রুপিংঃ যে গ্রুপিং ব্যবস্থায় প্রতিটি সেলের ধনাত্মক প্রান্ত এক প্রান্তে এবং ঋণাত্মক প্রান্ত অপর প্রান্তে যুক্ত করে সমস্ত সেল দ্বারা গ্রুপিং করতে হবে, তাদের ভোল্টেজ রেটিং অবশ্যই সমান হতে হবে। প্যারালাল গ্রুপিংয়ে বিদ্যুৎচালক বল অপরিবর্তিত থাকে এবং কারেন্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। নিচে তার সার্কিট চিত্র দেওয়া হলোঃ
চিত্রঃ সেলের প্যারালাল সংযোগ। |
এখানে,
V = V₁ = V₂ = V₃
I = I₁ + I₂ + I₃
V = মোট ভোল্টেজ।
V₁, V₂, V₃ = পৃথক পৃথক সেলের ভোল্টেজ।
I = মোট কারেন্ট।
I₁, I₂, I₃ = পৃথক পৃথক সেলের কারেন্ট।
সিরিজ-প্যারালাল গ্রুপিংঃ যে গ্রুপিংয়ে কিছুসংখ্যক সেলকে সিরিজ এবং কিছুসংখ্যক সেলকে প্যারালাল সংযোগ করা হয়, তাকে সিরিজ-প্যারালাল গ্রুপিং বলে। যে সমস্ত সেল সিরিজ প্যারালাল গ্রুপিং করতে হবে, তাদের ভোল্টেজ এবং কারেন্ট রেটিং অবশ্যই সমান হওয়া দরকার। চিত্রে এ ব্যবস্থা দেখানো হলোঃ-
চিত্রঃ সেল সিরিজ-প্যারালাল সার্কিট। |
এখানে,
সিরিজ গ্রুপ-১
I₁₁ = I₁ = I₂ = I₃
V₁₁ = V₁ + V₂ + V₃
সিরিজ গ্রুপ-২
I₁₂ = I₄ = I₅ = I₆
V₁₂ = V₄ + V₅ + V₆
সিরিজ প্যারালাল গ্রুপ
I = I₁₁ + I₁₂
V = V₁₂ = V₁₁
সেল-এর অভ্যন্তরীণ রেজিস্ট্যান্সঃ
সেলের বাইরের সার্কিটের নেগেটিভ প্রান্ত থেকে পজেটিভ প্রান্তে ইলেকট্রনের প্রবাহ হয় অর্থাৎ পজেটিভ প্রান্ত থেকে নেগেটিভ প্রান্তে বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়। সেলের ভিতরে পজেটিভ প্রান্ত থাকে, নেগেটিভ প্রান্তে ইলেকট্রন প্রবাহে কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। এ বাধাকে অভ্যন্তরীণ রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। ধরা যাক, n সংখ্যক সেল সিরিজে যুক্ত এবং প্রতিটি সেলের আন্তঃ রেজিস্ট্যান্স r ওহমস। অতএব, মোট আন্তঃরোধ nr ওহমস। যদি লোড রেজিস্ট্যান্স R হয়, তবে সর্বমোট রেজিস্ট্যান্স, Rt = (nr + R).
এখানে,
nr = r₁ + r₂ + r₃ + rₙ এর যোগফল।
সেলের ভোল্টেজ রেটিংঃ কোনো সেলের নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভোল্টেজ প্রদান করার ক্ষমতাকে তার ভোল্টেজ রেটিং বলে। ভোল্টেজ রেটিং সেলের অভ্যন্তরীণ গঠন এবং ব্যবহৃত পদার্থের উপর নির্ভর করে। সাধারণত ভোল্টেজ রেটিং প্রস্তুতকারক কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে।
সেলের কারেন্ট রেটিংঃ কোনো সেলের নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারেন্ট প্রদানের ক্ষমতাকে তার কারেন্ট রেটিং বলে । সেলের এ ক্ষমতা তার অভ্যন্তরীণ গঠন ও ব্যবহৃত পদার্থের উপর নির্ভর করে। এটি প্রস্তুত প্রণালির উপর নির্ভরশীল এবং প্রস্তুতকারক কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে। সেলের সর্বমোট রেটিং সাধারণত অ্যাম্পিয়ার ঘণ্টা দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
সেল-এর ব্যবহারঃ
সেলের ব্যবহার উল্লেখ করা হলো-
(ক) বিরতিযুক্ত বা সবিরাম বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য এক তরল জাতীয় সেল ব্যবহার করা হয়। টেলিফোন, টেলিগ্রাম, বৈদ্যুতিক ঘণ্টা প্রভৃতি কৌশল এবং গবেষণাগারে এ জাতীয় সেল ব্যবহার করা হয়।
(খ) ড্রাই সেলকে যে কোনো অবস্থানে রাখা যায়। এ কারণে ট্রানজিস্টর, রেডিও, টর্চ লাইট, বৈদ্যুতিক খেলনা, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, ক্যামেরা ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়।
(গ) যেখানে কম মানের বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রয়োজন হয়, সেখানে বিদ্যুৎচালক বল নির্ণয় করার কাজে এটি ব্যবহার করা হয়।
(ঘ) সঞ্চায়ক সেল মোটরগাড়িতে বিদ্যুৎ স্ফুরণের কাজে এবং জাহাজ, ট্রেন, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, পেট্রোল ইঞ্জিন, ডিজেল ইঞ্জিন এবং এরোপ্লেনে বাতি জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজেও এ প্রকার সেল ব্যবহার করা হয়। পাওয়ার সাবস্টেশনে রিলেসমূহ চালনার কাজেও ব্যবহার করা হয়।
ব্যাটারিঃ
ব্যাটারি হলো সেলের সমন্বয়। প্রয়োজনে বেশি পরিমাণ কারেন্ট এবং ভোল্টেজ পাওয়ার জন্য কয়েকটি সেল একত্রে সংযোগ করলে, তাকে ব্যাটারি বলে। সেলের সিরিজ, প্যারালাল এবং সিরিজ প্যারালাল গ্রুপিং করে ব্যাটারি তৈরি করা হয়, যার ফলে আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোল্টেজ পেতে পারি।