ইঞ্জিন শীতলীকরণ পদ্ধতি বা ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ইঞ্জিন শীতলীকরণ পদ্ধতিঃ

ইঞ্জিনের কর্ম পদ্ধতি হতে আমরা জেনেছি যে, অন্তদাহী ইঞ্জিনের প্রজ্জ্বলিত জ্বালানির তাপশক্তিই যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আবার অতিরিক্ত তাপমাত্রা ইঞ্জিনের অংশগুলো গলিয়ে অকেজ করে দিতে পারে। তাই ইঞ্জিন সৃষ্ট তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমায় রেখে সর্বাধিক কার্যদক্ষতা পেতে ইঞ্জিন শীতল করা হয় । এ থেকে আমরা ইঞ্জিনের শীতলীকরণের সংজ্ঞা দিতে পারি।

ইঞ্জিন শীতলীকরণ বা ইঞ্জিন কুলিং পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ইঞ্জিন শীতলীকরণঃ

যে পদ্ধতির মাধ্যমে ইঞ্জিনের উত্তপ্ত অংশগুলোতে সৃষ্ট ক্রমবদ্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে একে কার্যকরী তাপমাত্রায় (Workig temperature) সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাকে ইঞ্জিন শীতলীকরণ বলা হয়।

ইঞ্জিন শীতলীকরণের উদ্দেশ্য কি?

কুলিং বা শীতলীকরণ ইঞ্জিনের একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া। এক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, উৎপাদিত তাপের প্রায় ২৫ শতাংশ মাত্র কার্যে রূপান রিত হয়। এটা ইঞ্জিনের দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। অবশিষ্ট তাপ ইঞ্জিনে বিভিন্ন ভাবে অপচয় হয়। এ অতিরিক্ত তাপকে ইঞ্জিন থেকে দূর করতে না পারলে মাত্রাতিরিক্ত তাপে ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবার ভয় থাকে।

আসুন, আমরা ইঞ্জিনকে কেন শীতলীকরণ করব এ বিষয়ে আলোচনা করি। প্রজ্জ্বলনের সময় সংকোচন চেম্বারে অতি উচ্চ তাপ (পেট্রোল ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে ১২০০°C এবং ডিজেল ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে প্রায় ২০০০°C) উৎপন্ন হয়, যেখানে ইস্পাতের গলনাংক ১৭৫০°C এবং লোহার গলনাংক ১৫৩০°C। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় অয়েলের ধর্ম নষ্ট হয়ে ইঞ্জিনের ফ্রিকশন জনিত ক্ষয় বাড়িয়ে তোলে।

সংকোচন চেম্বারকে শীতল না করে ইঞ্জিন চালাতে থাকলে ইঞ্জিনের অভ্যন্তরীণ অংশগুলো যেমন-সিলিন্ডার ওয়াল, সিলিন্ডার হেড, পিস্টন, লাইনার, ভাল্ভ ইত্যাদি জ্বলে বেকে বা গলে যেতে পারে। আবার ইঞ্জিনকে বেশি শীতল করলে এর কার্যদক্ষতা কমে যায়। তাই, ইঞ্জিনকে একটি নিদিষ্ট তাপমাত্রা পর্যন্ত শীতল করতে হয়। এ নির্দিষ্ট তাপমাত্রাকে কার্যকরী তাপমাত্রা (Working temperature) বলে।

সংকোচন কম্বাশন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মোট তাপের ৩০-৩৫ শতাংশ তাপ দূর করে ওভার হিটিং (Over Heating) জনিত কারণে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশগুলো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য, লুব অয়েলের ধর্মকে অক্ষুন্ন রেখে লুব্রিকেটিং সিস্টেমকে কর্মক্ষম রাখার জন্য এবং যে কোন আবহাওয়ায়, লোড কন্ডিশনে ও স্প্রীডে ইঞ্জিনকে একটি অপরিবর্তিত (Constant) কার্যকরী তাপমাত্রায় রেখে সর্বোচ্চ তাপীয় দক্ষতায় একে পরিচালিত করাই ইঞ্জিন শীতলীকরণের উদ্দেশ্য।

ইঞ্জিন শীতলীকরণের প্রয়োজনীয়তাঃ

১। ইঞ্জিনের কার্য সম্পাদনের জন্য সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা।

২। দহন কক্ষে দহনের ফলে উৎপন্ন অতিরিক্ত তাপ অপসারণ করা।

৩। জ্বালানির পূর্বজ্বলন এবং ইঞ্জিনকে বিস্ফোরণ হতে রক্ষা করা।

৪। ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের মধ্যে সঠিক তৈলাক্তকরণ (Lubrication) বজায় রাখা।

ইঞ্জিন শীতলীকরণের মূলনীতিঃ

ইঞ্জিন শীতলীকরণ পদ্ধতির মূলনীতি হচ্ছে ইঞ্জিনের জ্যাকেটে পরিমিত ঠান্ডা পানি বা বায়ু সরবরাহের মাধ্যমে ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখা। অত্যধিক ঠান্ডা ও অতিরিক্ত গরম দুটোই ইঞ্জিনের জন্য ক্ষতিকারক। সাধারণত শীতলীকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে পেট্রোল ইঞ্জিনে তাপমাত্রা ৭১°C হতে ৮০°C এবং ডিজেল ইঞ্জিনের তাপমাত্রা ৮৮°C হতে ৯০°C এর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। শীতলীকরণ পদ্ধতিতে পানি প্রবাহের উষ্ণতা প্রবেশ পথে ৩৫°C হতে ৪৫°C এবং বর্হিমুখে ৭০°C হতে ৮০°C হয়ে থাকে।

ইঞ্জিন শীতলীকরণ পদ্ধতিসমূহঃ

ইঞ্জিনকে বিভিন্নভাবে শীতলীকরণ করা যায়। আসুন আমরা ইঞ্জিন শীতলীকরণের পদ্ধতিগুলো জেনে নেই।

ইঞ্জিনকে প্রধানত বায়ু শীতলীকরণ পদ্ধতি (Air cooling system) এবং পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Water cooling system) -এ দু’পদ্ধতিতে শীতল করা যায়।

ক) বায়ু শীতলীকরণ পদ্ধতি (Air cooling system):

এ পদ্ধতিতে প্রবল বায়ু প্রবাহ সিলিন্ডার হেডের চতুর্দিকে প্রবাহিত করা হয়। সিলিন্ডারের চতুর্দিকে বহির্ভাগে মাছের পাখনার ন্যায় অসংখ্য ফিন (Fins) বা রিব তৈরি করে সিলিন্ডারের কুলিং সারফেস এরিয়া (Cooling surface area) বাড়ানো করা হয়। এ ফিনগুলো তাপ সুপরিবাহী ধাতু দ্বারা তৈরি। ফলে সিলিন্ডারের তাপমাত্রা এতে পরিবাহিত হয় এবং ফিনগুলো প্রচুর পরিমানে খোলা বাতাসের সংস্পর্শে এসে সিলিন্ডারসহ শীতল হয়।

ইঞ্জিনের সংস্পর্শে শীতল বায়ু গরম হয়ে ঊর্ধ্বগামী হয় এবং শীতল বায়ু তা পূরণ করে। কোন কোন ইঞ্জিনে প্রত্যক্ষ বায়ু সঞ্চালনের জন্য ক্র্যাংক শ্যাফটের এক প্রান্তে ফ্যান বা ব্লোয়ার সংযুক্ত থাকে, যা বায়ু পরিচালনার মাধ্যমে ফিনগুলোকে শীতল করে ইঞ্জিনকে অধিক উষ্ণতা হতে রক্ষা করে। সাধারণ বায়ু শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় - মটর সাইকেল, স্কুটারে ব্যবহৃত হালকা ইঞ্জিনগুলোতে কিছু সংখ্যক গাড়ীর ইঞ্জিনে, উড়োজাহাজের ইঞ্জিনে এবং ছোট ধরনের শক্তি প্রকল্পে।

মটর সাইকেল ও স্কুটারের ক্ষেত্রে এদের সম্মুখ গতি দিয়ে পর্যাপ্ত বাতাস পায়। আধুনিক কালে কিছু ট্রাক্টরেও এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পদ্ধতির তাপ পরিবহিতা নির্ভর করে ফিনস এর সারফেস এরিয়া (Fins surface area), ইঞ্জিনের গতি ও ঠান্ডা বাতাসের পরিমাণ এবং ফিনস (Fins) ও বাতাসের তাপমাত্রার উপর। বায়ু শীতলীকরণ ইঞ্জিন পানি শীতলীকরণ ইঞ্জিন অপেক্ষা গরম থাকে এবং ভারী তৈলাক্তকারক তেল দরকার হয়।

বায়ু শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহারের কিছু সুবিধা ও অসুবিধাঃ

বায়ু শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহারে কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। আসুন, আলোচনার মাধ্যমে আমরা তা জেনে নেই।

সুবিধাঃ

১। গঠন প্রকৃতি সরল।

২। ওজনে হালকা এবং আকারে ছোট।

৩। এতে পানি শীতলীকরণ ইঞ্জিনের মত ওয়াটার জ্যাকেট (Water Jackets), রেডিয়েটর (Radiator) সার্কুলেটিং পাম্প (Circulating pump) এবং শীতল পানির প্রয়োজন পড়ে না।

৪। তৈরিতে খরচ কম এবং রক্ষণাবেক্ষণে তেমন যত্ন নিতে হয় না।

৫। এ পদ্ধতিতে পানি ব্যবহৃত হয় না বলে খুব ঠান্ডা আবহাওয়ায় বরফ জমার সম্ভাবনা নেই এবং কোন এন্ট্রি ফ্রিজের (Antri Freez) প্রয়োজন হয় না।

৬। এ পদ্ধতিতে যান্ত্রিক ত্রুটি খুব কম দেখা যায়।

অসুবিধাঃ

১। ইঞ্জিনের সকল অংশ সমানভাবে শীতল হয় না। ফলে সিলিন্ডার ও সিলিন্ডার হেডের বিকৃতি ঘটতে পার।

২। পাখার ব্যবহার এবং ওয়াটার জ্যাকেট না থাকায় এ ধরনের ইঞ্জিন গোলমালপূর্ণ বিদঘুটে শব্দ করতে পারে।

৩। বহু সিলিন্ডার (Multi cyInder) বিশিষ্ট ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক নয়।

৪। বায়ু শীতলকরণ পদ্ধতি পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি অপেক্ষা কম দক্ষ।

খ) পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Water cooling system):

ইঞ্জিন অতিরিক্ত উত্তপ্ত এবং কার্যকরী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে পূর্ণ কর্ম দক্ষতা পেতে পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পানি শীতলীকরণ পদ্ধতির সংজ্ঞা আমরা নিণেক্তভাবে দিতে পারি। যে পদ্ধতিতে ইঞ্জিনের উত্তপ্ত অংশগুলোতে (সিলিন্ডার লাইনার ও প্রজ্বলন চেম্বারের চতুর্দিকে) শীতল পানির প্রবাহ বজায় রেখে ইঞ্জিনকে শীতল রাখা হয়, তাকে পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি বলা হয়।

পানি শীতলীকরণ পদ্ধতিতে সিলিন্ডার হেড ও ব্লকের ভেতর পানি প্রবাহের রাস্তা থাকে। একে ওয়াটার জ্যাকেট বলা হয়। প্রজ্জ্বলনের উচ্চ চাপের প্রভাবে ওয়াটার জ্যাকেটের পানি উত্তপ্ত হয়। এ উত্তপ্ত পানিকে রেডিয়েটরে শীতল করে আবার ওয়াটার জ্যাকেটে পাঠানো হয়। সমস্ত প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ভাবে সম্পন্ন হয়।

পানি শীতলীকরণ পদ্ধতিকে নিম্নলিখিত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-

১। সরাসরি পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Non Return Water Cooling system)

২। থার্মো-সাইফণ পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Thermo-syphone water cooling system)

৩। ওপেন হোপার পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Open Hopper water cooling system)

৪। পাম্প বা ফোর্স সার্কুলেশন পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Pump or Force circulation water cooling system)

আসুন আলোচনার মাধ্যমে আমরা এগুলোর কার্য পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হই।

১। সরাসরি পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Non-Return water cooling system):

এ পদ্ধতিতে পানিকে সরাসরি ইঞ্জিনের সিলিন্ডারে পাঠানো হয় এবং গরম পানি সরাসরি বের করে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে গরম পানি পুনরায় শীতল করে ব্যবহার করা হয় না। যেখানে প্রচুর পানি মওজুদ আছে সেখানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। স্বল্প হর্স পাওয়ারের (H.P.) সেচ পাম্প যুক্ত ইঞ্জিন হচ্ছে এ পদ্ধতির একটি উদাহরণ।

২। থামো-সাইফণ পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Thermo-syphone water coling system):

উত্তপ্ত পানি সম্প্রসারণের মাধ্যমে হালকা হয়ে ওপরের দিকে যায়। অপরপক্ষে শীতল পানি ভারী হওয়ায় নিচের দিকে নেমে আসে। এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে থার্মো-সাইফণ পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি কার্য সম্পাদন করে।থার্মো-সাইফণ পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি নিম্নলিখিত অংশগুলো নিয়ে গঠিতঃ-

রেডিয়েটর (Radiator): পানি ধারন করে। এর ওপরের অংশে গরম পানি এবং নিচের অংশে ঠান্ডা পানি থাকে। মাঝখানে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে । যা ঢেউয়ের মত এবং একে প্যাসেজ বলে। যার মধ্যে দিয়ে পানি আসার সময় শীতল হয়। ফ্যান (Fan)t রেডিয়েটরের পানিকে শীতল করার জন্য ফ্যান ব্যবহার করা হয়। সাধারণত রেডিয়েটরের মধ্য বরাবর এক পাশে এটা ব্যবহার করা হয়।

হোজ পাইপ (Hose pipe): রেডিয়েটর হতে ইঞ্জিন ব্লকে পানি গমনাগমনের পথকে হোজ পাইপ বলে ।

ওয়াটার জ্যাকেট (Water jacket): সিলিন্ডার ব্লক অর্থাৎ সিলিন্ডারের বহিরাবরণের সাথে একটি শুন্যস্থান, যা চারপাশে আবদ্ধ থাকে। একে ওয়াটার জ্যাকেট বলে। সাধারণত শীতল পানি এ জ্যাকেটের মধ্য দিয়ে গমন করে এবং সিলিন্ডারের বহিরাবরণ শীতল করে।

থার্মো-সাইফণ পানি শীতলীকরণ পদ্ধতির কার্যপ্রণালিঃ

প্রথমে ওয়াটার জ্যাকেটের মধ্যে শীতল পানি হোজ পাইপের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এ পানি উত্তপ্ত সিলিন্ডার হেড ও ইঞ্জিন ব্লকের তাপ শোষণ করে উত্তপ্ত হয়। উত্তপ্ত পানি সম্প্রসারণের মাধ্যমে হালকা হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। অতঃপর এ উত্তপ্ত পানি ওয়াটার জ্যাকেটের রেডিয়েটরের হোজ পাইপের মাধ্যমে সাইফনিং (Syphoning) ক্রিয়ার ফলে রেডিয়েটরে আসে। সেখানে বায়ু পরিবেস্টিত নলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ফ্যান দিয়ে প্রবাহমান বাতাসের সাহায্যে ও রেডিয়েটরের মধ্যে বিকিরণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে উত্তপ্ত পানি শীতল হয়।

শীতল হওয়ার ফলে ওজনে ভারী পানি রেডিয়েটরের নিভাগের প্যাসেজ দিয়ে রেডিয়েটরের নিচের অংশে চলে আসে। পানি সঞ্চালনের জন্য এ পদ্ধতিতে কোন পাম্প ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। যখন হালকা পানি জ্যাকেট হতে রেডিয়েটরে চলে আসে তখন জ্যাকেটে শুন্যতার সৃষ্টি হয়। এ শুন্যতার কারণে রেডিয়েটরের নিচের অংশে জমাকৃত শীতল পানি হোজ পাইপের মাধ্যমে পুনরায় ওয়াটার জ্যাকেট প্রবেশ করে।

ইহা পুনরায় উত্তপ্ত হয় এবং রেডিয়েটরে শীতল হতে থাকে। এভাবে এ প্রক্রিয়াটি পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে। এ পদ্ধতি ট্রাক্টর ও অন্যান্য স্থায়ীভাবে অবস্থানরত ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হয়।

থার্মো-সাইফণ পানি শীতল করণ পদ্ধতি ব্যবহারের কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। আসুন আলোচনার মাধ্যমে আমরা তা জেনে নেই।

এ পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধাগুলো নিম্নরূপঃ

সুবিধাঃ

১। এ পদ্ধতি সকল ভারী ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হয়।

২। এতে সিলিন্ডারের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমায় বজায় থাকে।

৩। পানি অতি দ্রুত ঠান্ডা হয় এবং অল্প পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়।

৪। পাম্প থাকার ফলে পানির প্রবাহ স্থায়ী থাকে।

অসুবিধাঃ

১। এ পদ্ধতি কিছুটা জটিল।

২। রেডিয়েটরের সুক্ষ্ম পাইপ বা ফিন নষ্ট হলে এ পদ্ধতি তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না।

ওপেন হোপার শীতলীকরণ পদ্ধতি (Open Hopper water cooling system):

এ পদ্ধতি থার্মোর্সাইফন শীতলীকরণ পদ্ধতির অনুরূপে কার্য সম্পাদন করে। ওপেন হোপার শীতলীকরণ পদ্ধতিতে সিলিন্ডার এবং সিলিন্ডার হেডের চারিদিকে ওয়াটার জ্যাকেট থাকে। একটি উম্মুক্ত রিজার্ভার (Hopper) হতে পানি ওয়াটার জ্যাকেটের দিকে প্রবাহিত হয়। ওয়াটার জ্যাকেটের পানি উত্তপ্ত হয়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে হালকা হয়ে রিজার্ভারের (Hopper) দিকে প্রবাহিত হয়।

সেখানে ফুটন্ত পানি বাষ্প হতে থাকে। বাষ্প তার বাষ্পীয় সুপ্ততাপকে (537 Kcal) ঐ ফুটন্ত পানি হতে গ্রহণ করে। ফলে ফুটন্ত পানি শীতল হয়। এ পদ্ধতিতে পানি অনবরত বাষ্প হতে থাকে বলে কিছুক্ষণ পর পর রিজার্ভার বা হোপারে (Hopper) পানি যোগ করতে হয়। এ পদ্ধতির সরাসরি ব্যবহার বর্তমানে নেই বললেই চলে।

৪। পাম্প বা ফোর্সড সার্কুলেশন পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি (Pump or Forced circulation water cooling system):

পাম্প বা ফোর্সড সার্কুলেশন পদ্ধতিতে ইঞ্জিন শীতল করার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার গঠন থার্মোর্সাইফন যন্ত্রের প্রায় অনুরূপ। তবে এ পদ্ধতি কিছুটা উন্নত এবং এতে কিছু অতিরিক্ত অংশ দেখা যায়। এ পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর এবং চলন্ত ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হয়। গাড়ী, (Cars ) ট্রাক্টস (Tracts) ট্রাক্টরস (Tractors) ইত্যাদি ইঞ্জিন শীতলীকরণে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুনঃ রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনার গাইডলাইন

এ পদ্ধতিতে নিমোক্ত অংশগুলোর কার্যকারিতার মাধ্যমে ইঞ্জিন শীতল হয়। যথাঃ-

১। ওয়াটার পাম্প (Water pump )

২। ফ্যান (Fan)

৩। রেডিয়েটর এবং প্রেসার ক্যাপ। (Radiator and pressure cap)

৪। ফ্যান বেল্ট (Fan belt)

৫। ওয়াটার জ্যাকেট (Water jacket)

৬। থার্মোস্ট্যাট ভালভ (Thermostat valve)

৭। টেম্পারেচার গেজ (Temperature gauge)

৮। হোজ পাইপ (Hose pipe)

ওয়াটার পাম্প (water pump):

পানিকে ইঞ্জিন ব্লকে প্রেরণ করার জন্য ওয়াটার সেন্ট্রিফিউগ্যল (centrifugal) পাম্প ব্যবহার করা হয়। এটা শীতল পানি গমনের হোজ পাইপের মধ্যে সিলিন্ডার ব্লকের সামনে থাকে।

এ পাম্প নিমোক্ত অংশগুলো নিয়ে গঠিত। যথাঃ-

১। বডি (Body or casing)

২। ইমপেল্যার (Impeller or Rotor)

৩ । শ্যাফট (Shaft)

৪। বিয়ারিং (Bearing or Bush)

৫। ওয়াটার পাম্প সিল (Water pump seal)

৬। পুলি (Pulley)

রেডিয়েটরের নিচের অংশের সাথে পাম্পের সাকশন সাইড (Suction side) যুক্ত থাকে। শক্তি ক্র্যাংকশ্যাফটের (Crankshaft) শেষাংশ হতে পুলির মাধ্যমে পাম্প স্পিন্ডলে (Pump spindle) ট্রান্সফার (Transfer) হয়।

আরও পড়ুনঃ ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ বা পিচ্ছিল করণ পদ্ধতি বা ইঞ্জিন লুব্রিকেটিং সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ফ্যান (Fan):

সাধারণত ফ্যান পাম্পের পুলির সাথে ঘোরে। কিছু ইঞ্জিনে আবার ফ্যান সরাসরি ক্র্যাংকশ্যাফট এর সাথে যুক্ত থাকে।

এটা দু'ভাবে ইঞ্জিনকে শীতল করে। যথাঃ-

১। মুক্ত বাতাস রেডিয়েটরে প্রবাহ করে এর শীতলীকরণ বাড়িয়ে দেয়।

২। বিশুদ্ধ বাতাস ইঞ্জিনের বাইরের অংশে প্রবাহ করে শীতলীকরণের দক্ষতা বাড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুনঃ পেট্রোল ইঞ্জিনের প্রধান কার্যকরী অংশসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

রেডিয়েটর (Radiator):

ইঞ্জিন প্রদত্ত গরম পানি শীতল করার উদ্দেশ্যে রেডিয়েটর ব্যবহৃত হয়। এর প্রধান তিনটি অংশ হলো উঁচু ট্যাংক (Upper tank), নিচু ট্যাংক (Lower tank) ও টিউবস (Tubes)। ইঞ্জিন প্রদত্ত গরম পানি উঁচু ট্যাংক হতে টিউবের মাধ্যমে নিচে চলে আসে। টিউবের চতুর্দিকের ফিন গরম পানি হতে তাপ গ্রহণ করে। অতিরিক্ত পানি ও বাষ্প হতে রক্ষার জন্য একটি ওভার ফ্লো পাইপ (Over flow pipe) উচু ট্যাংকের সাথে যুক্ত থাকে।

রেডিয়েটর তিন প্রকার। যথাঃ-

১। গিলড টিউব রেডিয়েটর (Gilled tube radiator)

২। টিউবুলার রেডিয়েটর (Tubular radiator)

৩। হানি কম্ব বা সেলুলার রেডিয়েটর (Honey comb or cellular radiator)

ইঞ্জিন শীতলীকরণ বা ইঞ্জিন কুলিং পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

চিত্রঃ একটি সাধারণ রেডিয়েটর।

থার্মোস্ট্যাট ভাল্ভ (Thermostate valve):

এটা এক প্রকার চেক (Check) ভালভ, যা তাপের প্রভাবে খুলে এবং বন্ধ হয়। এ ভাল্ভ ইঞ্জিনের পানি বর্হিগমনে (Water outlet) স্থাপন করা থাকে। উত্তপ্ত অবস্থায় থার্মোস্ট্যাট ভালভ বন্ধ থাকে এবং পাম্প সিলিন্ডার ব্লক ও হেডে পানি সঞ্চালন করে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থার্মোস্ট্যাট ভাল্ভ খুলে যায় এবং গরম পানি রেডিয়েটরে প্রবেশ করে।

ইঞ্জিন শীতলীকরণ বা ইঞ্জিন কুলিং পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
চিত্রঃ থার্মোস্ট্যাট ভাল্ভ।

একটি আদর্শ থার্মোস্ট্র্যাট ভাল্ভ ৭০°C হতে ৭৫°C তাপমাত্রায় খুলে এবং ৮২°C তাপমাত্রায় পূর্ণভাবে খুলে।

থার্মোস্ট্যাট ভাল্ভ তিন প্রকার। যথাঃ-

১। বিলো টাইপ (Bellow type)

২। বায়োমেটালিক টাইপ (Bimetalic type)

৩। পিল্লেট টাইপ (Pellet type)

ট্রাক্টর, মোটরগাড়ী ইত্যাদি ইঞ্জিন এ পদ্ধতিতে শীতল করা হয়।

পাম্প বা ফোর্সড সাকুলেশন শীতলীকরণ পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিম্নরূপঃ

সুবিধাঃ

১। সকল প্রকার ভারী ইঞ্জিনে ব্যবহার করা যায়।

২। ইঞ্জিনের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা যায়।

অসুবিধাঃ

১। পানির প্রবাহ ধ্রুব রাখা যায়। পানি অতি দ্রুত ঠান্ডা হয়, পরিমাণে কম লাগে এবং বিদপজনক নয়।

২। এ পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল।

৩। রেডিয়েটরের সুক্ষ্ম পাইপ নষ্ট হয়ে গেলে এ পদ্ধতি তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না।

৪। পাম্প চালানোর জন্য অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়।

আরও পড়ুনঃ ডিজেল ইঞ্জিন ও ডিজেল ইঞ্জিনের প্রধান কার্যকরী অংশসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

সারমর্মঃ ইঞ্জিন কর্তৃক সৃষ্ট তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমায় রেখে ইঞ্জিনকে সর্বাধিক কর্মক্ষম রাখাই হচ্ছে ইঞ্জিন শীতলীকরণের উদ্দেশ্য। বায়ু শীতলীকরণ ও পানি শীতলীকরণ -এ দু’পদ্ধতিতে ইঞ্জিন শীতল করা হয়। পানি শীতলীকরণ পদ্ধতি আবার অনেক প্রকার হয়ে থাকে।

আরও পড়ুনঃ ইঞ্জিনের মূল কর্মপদ্ধতি বা ইঞ্জিনের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url