হার্ডেনিং কি? হার্ডেনিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
হার্ডেনিং এর সূচনা (Introduction):
হার্ডেনিং প্রক্রিয়া হলো একধরনের হিট ট্রিটমেন্ট প্রক্রিয়া। প্রধানত লৌহজাত বা লৌহাজাত অ্যালয়তে এটা করা হয়। হার্ডেনিং-এর ফলে লৌহজাত বা লৌহজাত অ্যালয়তে গাঠনিক পরিবর্তন হয় এবং এটার স্থিতিশীলতা, কার্বনের হার, তাপমাত্রা, শীতল করার সময় ও মাধ্যম প্রভৃতির উপর নির্ভরশীল যেমনঃ ০.৩% এর অধিক কার্বন বিশিষ্ট স্টিলকে হার্ডেনিং করলে এতে মর্টেনসাইটের সৃষ্টি হয়।
০.৯% কার্বন বিশিষ্ট হাইকার্বন স্টিলকে ঊর্ধ্ব ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার ৪০° থেকে সেঃ ৫০° সেঃ উপরের তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে কুয়েঞ্চিং করলে খুব শক্ত, ভঙ্গুর ও অল্প আঘাত প্রতিরোধক্ষম মর্টেনসাইটের সৃষ্টি হয়। মাইল্ড স্টিলে কার্বন উপস্থিতির শতকরা হার কম থাকে বলে হার্ডেনিং-এর সাধারণ নিয়মে শক্ত করা যায় না। অনধিক কার্বন বিশিষ্ট স্টিল খণ্ডটির উপরিভগে কার্বনের উপস্থিতি বৃদ্ধি করে উপরিতল কাঠিন্য করাকেই কেস হার্ডেনিং বলে।
এর ফলে স্টিল খণ্ডের উপরিতল শক্ততা বৃদ্ধি হওয়ায় সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। কোনো যন্ত্রাংশের অভ্যন্তর ভাগ নরম ও দুচ্ছেদ্যতা রেখে উপরিভাগ কাঠিন্য করাই কেস হার্ডেনিং-এর মূলনীতি। ০.২০%-০.৩৫% কার্বন বিশিষ্ট স্টিলকে কেস হার্ডেনিং করলে উপরিতল কাঠিন্য ও ক্ষয়রোধী এবং আভ্যন্তরীণ কোর নরম ও শক্ত হয়। কোনো জবের উপরিতলে কার্বনের হার বৃদ্ধি করাকে কার্বুরাইজিং বলে।
হার্ডেনিং প্রক্রিয়া (Hardening Process):
স্টিলকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় আনলে লৌহ ও কার্বনের মধ্যে গাঠনিক পরিবর্তন হয় এবং নিম্ন ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রা পর্যন্ত এ পরিবর্তন চলে। হার্ডেনিং-এর মূলনীতি হলো গাঠনিক পরিবর্তন ঘটানো এবং প্রয়োজন মতো উক্ত পরিবর্তনকে স্থিতিশীল রেখে কাঠিন্য বৃদ্ধি করা। এজন্য ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রা পর্যন্ত উত্তপ্ত করে দ্রুত ঠাণ্ডাকরণের মাধ্যমে গুণাগুণ পরিবর্তন করা হয়, একে হার্ডেনিং প্রক্রিয়া বা হর্ডেনিং বলে।
হার্ডেনিং এর উদ্দেশ্য (Objectives of Hardening):
নিম্নে হার্ডেনিং-এর উদ্দেশ্যগুলো সংক্ষেপে দেওয়া হলোঃ
১। ধাতব পদার্থ বা স্টিলের শক্তি বৃদ্ধি করা।
২। ধাতব পদার্থ বা স্টিলকে শক্ত করা।
৩ । কাটিং টুলস্ তৈরির জন্য এটা ব্যবহার উপযোগী করা।
৪। মেশিনের স্ট্রেসমুক্ত পার্টস নির্মাণের উপযুক্ত করা।
৫। স্টিলের ক্ষয় প্রতিরোধ করা।
৬ । এটা ধাতুর ভঙ্গুরতা, বৈদ্যুতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আপেক্ষিক আয়তন ইত্যাদি বৃদ্ধি করা।
৭। প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি ও অন্য ধাতুকে কাটার উপযোগী করে তোলা।
৮। ধাতুর গাঠনিক পরিবর্তন ঘটান।
৯ । প্রয়োজন মতো গাঠনিক পরিবর্তনকে স্থিতিশীল রেখে কাঠিন্য বৃদ্ধি করা।
আরও পড়ুনঃ ধাতু কাকে বলে? ধাতু কত প্রকার ও কি কি? ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
হার্ডেনিং প্রক্রিয়া বর্ণনা (Description of Hardening Process):
স্টিলকে সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে হার্ডেনিং করা হয়-
১। কেস হার্ডেনিং (Case hardening)
২। কার্বুরাইজিং (Carburizing)
(ক) প্যাক বা বক্স কার্বুরাইজিং (Pack or box carburizing)
(খ) গ্যাস কার্বুরাইজিং (Gas Carburizing)
(গ) লিকুইড কার্বুরাইজিং (Liquid carburizing)
৩। সায়ানাইডিং (Cyaniding)
৪। নাইট্রাইডিং (Nitriding)
১। কেস হার্ডেনিং (Case hardening):
এটা স্টিলের বাইরের উপরিভাগকে অধিকতর শক্ত করা বুঝায়। যে সকল স্টিল বা রট আয়রনের মধ্যে কার্বনের হার খুব কম থাকে, ঐ সকল ধাতুর উপরিভাগকে অধিক কার্বন বিশিষ্ট বাহিরের বস্তু হতে কার্বনকে রাসায়নিকভাবে যুক্ত করে কার্বন স্টিলের ন্যায় শক্ত আবরণ সৃষ্টি করার পদ্ধতিকে কেস হার্ডেনিং বলা হয়। এ আবরণের গভীরতা সাধারণভাবে নির্ভর করে কত সময়ব্যাপী ও কত বেশি পরিমাণ তাপের পরিমাপের উপর। অক্সিএসিটিলিন শেখার সাহায্যে কোনো ইস্পাতের তৈরি সম্পূর্ণ যন্ত্রাংশকে বা অংশবিশেষকে ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার সামান্য উপরের তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে শীতল পানি দ্বারা হঠাৎ ঠাণ্ডা করার প্রক্রিয়াকে ফ্লেম হার্ডেনিং বলে।
সাধারণত ০.৪% হতে ০.৭% কার্বন যুক্ত ইস্পাতকে এ প্রক্রিয়ায় হার্ডেনিং করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে হার্ডেনিং গভীরতা প্রায় ১.৬ মি.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একটি শিখা বা একাধিক শিখা ব্যবহার করা যায়। কেস হার্ডেনিং যন্ত্রপাতি অত্যল্প এবং হালকা বিধায় তা বহনযোগ্য এবং যে কোনো আকৃতির যন্ত্রাংশে ব্যবহার যোগ্য। কুয়েঞ্চিং-এর পর যন্ত্রাংশকে ১৭৫° সেঃ তাপ মাত্রায় উত্তপ্ত করে বাতাসে ঠাণ্ডা করা হয়।
অর্থাৎ টেম্পারিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পীড়নমুক্ত করা হয়। এ প্রক্রিয়ার অসুবিধা হলো এতে যন্ত্রাংশ অতিরিক্ত উত্তপ্ত হলে কুয়েঞ্চিং-এর ফলে নষ্ট হতে পারে, কার্বনের সংযুক্তি বেশি হলে চির দেখা যেতে পারে, যন্ত্রাংশ পাতলা হলে বেঁকে যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় ছোট-বড় সকল যন্ত্রাংশ হার্ডেনিং করা যায়। উপরের চিত্রে একটি গিয়ারের দাঁতের কেস হার্ডেনিং করা দেখানো হলো। বৃহদাকার শ্যাফট এবং গিয়ার সাধারণত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উত্তপ্ত করা হয়।
আরও পড়ুনঃ কিউপোলা চুল্লি কি? কিউপোলা চুল্লি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
২। কার্বুরাইজিং (Carburizing):
(ক) প্যাক ও বক্স কার্বুরাইজিং (Pack or Box Carburizing):
কোনো স্টিল খণ্ডের উপরিতলে বায়ু শূন্য অবস্থায় বন্ধ বাক্সের ভেতরে রেখে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি করাকে কার্বুরাইজিং বলে। এই প্রক্রিয়ায় ঢাকনাযুক্ত একটি কাস্ট আয়রন অথবা রট আয়রনের বাক্সের ভেতরে অগ্নিরোধী ইট (Fire Brick) দ্বারা আবেষ্টন করে নেওয়ার পর পোড়া চামড়া (Charred Leather) হাড়ের গুড়ো (Bone Dust), কাঠ কয়লা (Charcoal) ইত্যাদি বেশি কার্বনযুক্ত পদার্থের সঙ্গে বেরিয়াম (Barium) সোডিয়াম (Sodium)-এর কার্বনেট (Carbonate) মিশিয়ে ভর্তি করতে হয়।
(খ) গ্যাস কার্বুরাইজিং (Gas Carburizing): এই প্রণালিতে ও লো-কার্বন স্টিলের উপরিভাগকে হাই কার্বন স্টিলের ন্যায় শক্ত করা সম্ভব হয়। মাফল ফার্নেস (Muffle furnace) এর মধ্যে মিথেন (Methene) গ্যাসের কার্বন ও হাইড্রোজেনের সংশ্লিষ্ট আবহাওয়ার মধ্যে ধাতু খণ্ডটিকে ৯০০-৯৪০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে কিছু সময় ঐ একই তাপমাত্রায় রাখার পর বাইরে এনে মুক্ত বায়ুতে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা করা হয়।
(গ) লিকুইড কার্বুরাইজিং (Liquid Caburizing): এ পদ্ধতিতে একটি পাত্রে তরল লবণ (৭৫%-৮০%) সোডিয়াম কার্বোনেট (১০%-১৫%), সোডিয়াম ক্লোরাইড ৬%-১০%, সিলিকন কার্বাইড রাখা হয়। উক্ত পাত্রে স্টিল খণ্ড ডুবিয়ে রেখে ৮৫০% সেঃ এ উত্তপ্ত করা হয়। ফলে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে এবং কার্বন মনোঅক্সাইড স্টিল খণ্ডটিকে কার্বোরাইজড করে।
আরও পড়ুনঃ নরমালাইজিং কি? নরমালাইজিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
৩। সায়ানাইডিং (Cyaniding):
এই প্রণালিতে প্রথমে একটি পাত্রের মধ্যে পরিমাণে সোডিয়াম ক্লোরাইড (Sodium Chloride), সোডিয়াম কার্বনেট (Sodium Carbonate) এবং সোডিয়াম সায়ানাইড (Sodium Cyanide) গলিয়ে রাখা হয়। পরে কম কার্বনযুক্ত স্টিল খণ্ডটিকে ৭০০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে এই মিশ্রিত বাথের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ মিনিট কাল রেখে উপরিভাগকে শক্ত করা হয়।
৪। নাইট্রাইডিং (Nitriding):
নাইট্রাইডিং প্রক্রিয়ায় রট আয়রন বা স্টিলের তৈরি একটি বাক্সের মধ্যে স্টিল খণ্ডটিকে রেখে ইলেকট্রিক ফার্নেস (Electric Furnace)-এর মধ্যে ৪৮০০-৬৫০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করার পর অ্যামোনিয়া গ্যাস (Ammoniam Gas) এই বাক্সের মধ্যে প্রবাহিত করা হয়। ফলে স্টিল খণ্ডটির উপরিভাগে নাইট্রোজেন (Nitrogen) যুক্ত হয়ে যায়। পরে বাক্সটিকে বাইরে এনে মুক্ত বায়ুতে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা করা হয়। নাইট্রাইডিং করার পর আর একে হার্ডেনিং প্রক্রিয়ায় করার শক্ত করার প্রয়োজন হয় না।
হার্ডেনিং এর প্রয়োগক্ষেত্র (Field of Application of Hardening):
নিম্নে হার্ডেনিং এর প্রয়োগ ক্ষেত্র উল্লেখ করা হলোঃ-
শিল্প ব্যাপক উৎপাদনে ক্ষেত্রে হার্ডেনিং করা স্টিল প্রচুর ব্যবহার হয়ে থাকে। ট্যাপ, ডাই, মিলিং, কাটার, রেঞ্চ চিজেল, স্লেজ হ্যামার, হ্যাক্স বেল্ড, ফাইল প্রভৃতি কার্বন স্টিল দ্বারা তৈরি করে হার্ডেনিং মাধ্যমে এদের প্রয়োজনীয় গুণাগুণের পরিবর্তন এনে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুনঃ সংকর ধাতু কী? সংকর ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা