ভার্নিয়ার স্কেল কি? ভার্নিয়ার স্কেল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ভার্নিয়ার স্কেলঃ

ভার্নিয়ার স্কেল হলো একটি সূক্ষ্ম পরিমাপক ও পরীক্ষণ যন্ত্র, যার সাহায্যে কোন বস্তুর বা ওয়ার্কপিসের ভিতর, বাহির এবং গভীরতার মাপ সূক্ষ্মভাবে নেওয়া যায় বা পরীক্ষা করা যায়। এটি একটি প্রত্যক্ষ সেমি প্রিসিশন সরল মাপক যন্ত্র। এটির দুইটি আউটসাইড ‘জ’ এবং দুইটি ইনসাইড ‘জ' থাকে। এই ‘জ’-গুলো হাই কোয়ালিটি টুল স্টিল বা স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি এবং একটি বিমের সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে।

বিমের দুই ধারে সে.মি. এবং ইঞ্চিতে প্রধান স্কেল দাগাংকিত থাকে। চলমান ‘জ’ দুইটি একটি রিটেইনারের সাহায্যে প্রধান স্কেলের উপর দিয়ে নড়া চড়া করতে পারে। চলমান ‘জ’ দুইটি এবং রিটেইনারটি একটি ভার্নিয়ার স্কেলের সাথে সংযুক্ত থাকে। প্রতি জোড়া ‘জ’ মিলিত অবস্থায় ভার্নিয়ার স্কেলের এক পার্শ্ব বিম বা প্রধান স্কেলের সাথে শূন্য দাগে অবস্থান করে।

ভার্নিয়ার স্কেল দ্বারা কোন প্রকার অতিরিক্ত হিসাব ছাড়াই এক পার্শ্ব দিয়ে আউটসাইড এবং অপর পার্শ্ব দিয়ে ইনসাইড মাপ গ্রহণ করা যায়। তাছাড়া কোন কোন ভার্নিয়ার ক্যালিপারে মাথার দিকে ডেপথ প্রব (Depth Probe) থাকে যার সাহায্যে একই স্কেলের মাধ্যমে গভীরতার মাপও নেওয়া যায়।

ভার্নিয়ার স্কেলের বিভিন্ন অংশসমূহঃ

একটি ভার্নিয়ার স্কেল বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে গঠিত হয়। নিম্নে একটি চিত্রের সাহায্যে একটি আদর্শ ভার্নিয়ার স্কেল বিভিন্ন অংশ দেখানো হলো-

ভার্নিয়ার স্কেল
চিত্রঃ ভার্নিয়ার স্কেল।

ভার্নিয়ার স্কেলের বিভিন্ন অংশসমূহঃ

1. আউটসাইড ‘জ’স (Outside jaws)

2. ইনসাইড ‘জ’স ( Inside jaws)

3. ডেপথ প্ৰব (Depth probe )

4. প্রধান স্কেল (Main scale)- মেট্রিক পদ্ধতি।

5. প্রধান স্কেল (Main scale)- ব্রিটিশ পদ্ধতি।

6. ভার্নিয়ার স্কেল (Vernier scale)- মেট্রিক পদ্ধতি।

7. ভার্নিয়ার স্কেল (Vernier scale)- ব্রিটিশ পদ্ধতি।

8. রিটেইনার (Retainer) ভার্নিয়ার ক্যালিপার।

আউটসাইড ‘জ’স (Outside jaws): কার্যবস্তুর বাহিরের ব্যাস, প্রস্থ বা বেধ মাপার জন্য ব্যবহৃত হয়।

ইনসাইড ‘জ’স (Inside jaws): কার্যবস্তুর ভিতরের ব্যাস, অল্প ফাঁকা স্থানের প্রস্থ বা বেধ মাপার জন্য ব্যবহৃত হয়।

ডেপথ প্রব (Depth probe): কোন গর্ত বা ছিদ্রের গভীরতা মাপার জন্য ব্যবহৃত হয়।

প্রধান স্কেল, মেট্রিক (Main scale, Metric): ০.০৫ সে.মি. পর্যন্ত মাপ নেওয়া যায়।

প্রধান স্কেল, ব্রিটিশ (Main scale, British): সর্বনিম্ন ১/৬৪ ইঞ্চি পর্যন্ত মাপ নেওয়া যায়।

ভার্নিয়ার স্কেল (Vernier scale ): ১০, ২০ ও ২৫ ভাগ দাগ কাটা থাকে যেখানে প্রধান স্কেলের যথাক্রমে ৯, ১৯ ও ২৪ ঘরের সমান হয়।

ভার্নিয়ার স্কেল (Vernier scale ): ২৫ ভাগ দাগ কাটা থাকে যেখানে প্রধান স্কেলের ১ ইঞ্চি-তে ৪০ ঘর থাকে।

রিটেইনার (Retainer): চলমান চোয়াল বা ‘জ’ গুলো এবং ভার্নিয়ার স্কেল দুইটিকে দৃঢ় ভাবে ধরে রেখে বিম স্কেলের উপর দিয়ে নড়া চড়া করতে সাহায্য করে।

ভার্নিয়ার ধ্রুব (Vernier Constant) নির্ণয় পদ্ধতিঃ

প্রধান স্কেলের আকার অনুযায়ী ভার্নিয়ার স্কেলের আকার রৈখিক বা গোলাকার হয়ে থাকে। সকল ভার্নিয়ার স্কেল একই নীতিতে তৈরি হয় না। তৈরির নীতি অনুযায়ী ভার্নিয়ার স্কেলের ধ্রুবক নির্ধারিত হয়ে থাকে। প্রধান স্কেলের ক্ষুদ্রতম এক ঘরের মান এবং ভার্নিয়ার স্কেলের ক্ষুদ্রতম এক ঘরের মানের মধ্যকার পার্থক্যকে ভার্নিয়ার ধ্রুবক বলা হয়।

ধরা যাক,

একটি ভার্নিয়ার স্কেলের মোট ভাগ সংখ্যা ২০ এবং ভার্নিয়ার স্কেলের এই ২০ ঘরের দূরত্ব প্রধান স্কেলের ১৯ ঘরের সমান অর্থাৎ ১৯ মি.মি.।

সুতরাং, ভার্নিয়ার স্কেলের ২০ ভাগের দৈর্ঘ্য = ১৯ মি.মি.

অতএব, ভার্নিয়ার স্কেলের ১ ভাগের দৈর্ঘ্য = ১৯/২০ মি.মি. = ০.৯৫ মি.মি.

ভার্নিয়ার ধ্রুবক = প্রধান স্কেলের ক্ষুদ্রতম ১ ভাগের দৈর্ঘ্য – ভার্নিয়ার স্কেলের ক্ষুদ্রতম ১ ভাগের দৈর্ঘ্য।

= ১ মি.মি. – ০.৯৫ মি.মি.

= ০.০৫ মি.মি.

সাধারণত নিম্নে উল্লিখিত সূত্রের সাহায্যে ভার্নিয়ার ধ্রুবক নির্ণয় করা হয়ে থাকে । যথা-

ভার্নিয়ার কনস্ট্যান্ট = প্রধান স্কেলের এক ভাগের মান ÷ ভার্নিয়ার স্কেলের মোট ভাগ সংখ্যা।

উদাহরণ-১ঃ একটি ভার্নিয়ার ক্যালিপারের ভার্নিয়ার স্কেলের মোট ভাগ সংখ্যা ১০ যা প্রধান স্কেলের ৯ ভাগের দূরত্বের সমান। প্রধান স্কেলের ১ ভাগের মান ১ মি.মি.। ভার্নিয়ার ধ্রুবক বাহির কর।

সমাধানঃ

আমরা জানি,

ভার্নিয়ার কনস্ট্যান্ট = প্রধান স্কেলের এক ভাগের মান ÷ ভার্নিয়ার স্কেলের মোট ভাগ সংখ্যা।

= ১ মি.মি ÷ ১০

= ০.১ মি.মি.।

উত্তরঃ ভার্নিয়ার কনস্ট্যান্ট হবে ০.১ মি.মি.।

ভার্নিয়ার স্কেলের পরিমাপ পদ্ধতিঃ

(১) ভার্নিয়ার স্কেলের পরিমাপ পদ্ধতি (মেট্রিক):

বস্তুর প্রকৃত পরিমাপ সবসময় পূর্ণ সংখ্যায় হয় না। ভার্নিয়ার স্কেলের শূন্য দাগ যদি প্রধান স্কেলের যে কোন দাগের সাথে মিলে যায় তাহলে পরিমাপ তত মিমি হয়। কিন্তু ভার্নিয়ার স্কেলের শূন্য দাগ যদি প্রধান স্কেলের দুইটি দাগের মধ্যবর্তী কোন স্থানে অবস্থান করে তাহলে ভার্নিয়ার স্কেল থেকে মাপ পড়ার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে ভার্নিয়ার স্কেলের শূন্য চিহ্নিত দাগটি প্রধান স্কেলের যে দাগ অতিক্রম করে সে দাগ পর্যন্ত দূরত্বকে বস্তুর পূর্ণ পরিমাপ ধরা হয়।

আবার ভার্নিয়ার স্কেলে যত সংখ্যক দাগটি প্রধান স্কেলের একটি মাত্র দাগের সাথে একই সরলরেখায় চলে আসে বা সবচেয়ে কাছাকাছি হয় তার সাথে ভার্নিয়ার ধ্রুবক গুণ করে যা পাওয়া যায় তাকে ইতিপূর্বে প্রাপ্ত পূর্ণমাপের সাথে যোগ করে বস্তুর প্রকৃত পরিমাপ নির্ধারণ করা হয় ।

ভার্নিয়ার স্কেল
চিত্রঃ ভার্নিয়ার স্কেলের পরিমাপ পদ্ধতি।

(২) ভার্নিয়ার স্কেলের পরিমাপ পদ্ধতি (ব্রিটিশ):

প্রধান স্কেল এবং ভার্নিয়ার স্কেলের সমন্বয়ে মোট পরিমাপ নির্ধারিত হয়। এর প্রধান স্কেল ইঞ্চিতে দাগ কাটা থাকে। সাধারণত প্রতিটি ইঞ্চি সমান ১০ ভাগে বিভক্ত করে অপেক্ষাকৃত কম লম্বা দাগ সহ ছোট আকারের সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা থাকে যার মান ০.১ ইঞ্চি। এ ভাগগুলো আবার সমান ৪ (চার) ভাগে ভাগ করা থাকে যার মান ০.১/৪ = ০.০২৫ ইঞ্চি অর্থাৎ ইঞ্চি পদ্ধতির ভার্নিয়ার ক্যালিপার্সে প্রধান স্কেলের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্রতম ভাগ বা ঘরের মান ০.০২৫ ইঞ্চি। এ প্রকারের ভার্নিয়ার ক্যালিপার্সে ভার্নিয়ার স্কেলের মোট দাগ সংখ্যা থাকে ২৫ । সুতরাং ভার্নিয়ার ধ্রুবক হলো ০.০২৫/২৫ = ০.০০১ ইঞ্চি।

ব্রিটিশ পদ্ধতিতে ভার্নিয়ার স্কেল দ্বারা মাপ নেওয়ার জন্য প্রথমে ভার্নিয়ার স্কেলের শূন্য চিহ্নিত রেখাটি কয়টি পূর্ণ ইঞ্চি রেখা অতিক্রম করেছে এবং কয়টি এক ইঞ্চির ১০ ভাগের ১ ভাগ রেখা অতিক্রম করেছে ও কত সংখ্যক ৪০ ভাগের এক ভাগ রেখা অতিক্রম করেছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। এর পর লক্ষ করা হয় যে ভার্নিয়ার স্কেলের কত নম্বর রেখাটি প্রধান স্কেলের একটি মাত্র রেখার সাথে পূর্ণভাবে সরলরেখায় মিলিত হয়েছে।

ভার্নিয়ার স্কেলের শূন্য দ্বারা অতিক্রান্ত প্রত্যেকটি রেখার মাপ যোগ করে তার সাথে ভার্নিয়ার স্কেলের মিলিত দাগ সংখ্যাকে ভার্নিয়ার ধ্রুবক দ্বারা গুণ করে গুণফল পূর্বের যোগফলের সাথে যোগ করলে মোট যোগফল ভার্নিয়ার ক্যালিপারের মোট মাপ নির্দেশ করে।

ডিজিটাল ভার্নিয়ার স্কেল ও ইহার ব্যবহারঃ

ডিজিটাল ভার্নিয়ার স্কেল একটি সূক্ষ্ম পরিমাপক যন্ত্র যা দ্বারা কোন জব বা কার্যবস্তুর ভিতর ও বাহিরের পরিমাপ অতি সূক্ষ্মভাবে নির্ণয় করা যায় এবং পরিমাপ একটি এলসিডি ডিসপ্লে-এর মাধ্যমে সরাসরি ভেসে উঠে। ইঞ্চি অথবা মিলিমিটার বাটন চেপে পাঠ পছন্দমত সংগ্রহ করা যায়।

যে জব বা কার্যবস্তুর পরিমাপ নিতে হবে সেটিকে ডিজিটাল ভার্নিয়ার ক্যালিপারের এক্সটারনাল 'জ' এর মধ্যে স্থাপন করে আলতোভাবে স্পর্শ করানো হয়, ডিজিটাল ডিসপ্লেতে তখন পাঠ ভেসে ওঠে।

ভার্নিয়ার স্কেল
চিত্রঃ ডিজিটাল ভার্নিয়ার ক্যালিপার।

ভার্নিয়ার স্কেলের ব্যবহারঃ

কোন মসৃণ তলের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা চওড়া, বেধ বা পুরুত্ব পরিমাপ করার জন্য ভার্নিয়ার ক্যালিপার্স ব্যবহৃত হয়।তাছাড়া গোলক, সিলিন্ডার ইত্যাদির ব্যাস পরিমাপে এটি ব্যবহৃত হয়। পরীক্ষণ কাজেও ভার্নিয়ার ক্যালিপার্স ব্যবহার করা হয়। কোন পাইপ বা সিলিন্ডার এর আভ্যন্তরীণ ব্যাস পরিমাপে এটি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দুইটি তলের মধ্যকার ভেতরের মাপ গ্রহণ করতেও ভার্নিয়ার ক্যালিপার্স ব্যবহৃত হয়। গর্ত বা স্লটের গভীরতা, দুইটি তলের উচ্চতার পার্থক্য বা গভীরতা পরীক্ষা করতে বা পরিমাপ গ্রহণ করতে ভার্নিয়ার ক্যালিপার্স ব্যবহৃত হয়।

ভার্নিয়ার স্কেল
চিত্রঃ ভার্নিয়ার স্কেলের ব্যবহার।

ভার্নিয়ার স্কেলের যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতিঃ

১) ভার্নিয়ার স্কেল ব্যবহার করার সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়, এতে মাপের সঠিকতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

২) মেশিন চলন্ত অবস্থায় কার্যবস্তুর বা যন্ত্রাংশের মাপ ভার্নিয়ার ক্যালিপার দ্বারা নেওয়া নিষেধ।

৩) ভার্নিয়ার স্কেল ব্যবহার করার পর পরিষ্কার করে যথাযথ স্থানে রেখে দিতে হবে।

৪) ভার্নিয়ার স্কেলকে কাটিং টুলের সাথে রাখা নিষেধ।

৫) স্থির চোয়াল বা ‘জ’ -কে কার্যবস্তুর এক ধারে স্থাপন করে স্লাইডিং ‘জ’ কে ধীরে ধীরে অন্য পাশে স্থাপন করতে হয়।

৬) ভার্নিয়ার স্কেল দ্বারা রাফ সারফেসের মাপ গ্রহণ করা যাবে না।

৭) ভার্নিয়ার স্কেলকে কোন চুম্বকের সংস্পর্শে রাখা যাবে না।

৮) ভার্নিয়ার স্কেল কোন অংশ যাতে মরিচা না পড়ে এবং চলনশীল অংশ যাতে সহজেই চলাচল করতে পারে সেজন্য বিম স্কেলের উপরিভাগে ও স্ক্রু থ্রেডের বিভিন্ন স্থানে কিছু দিন পর পর মসৃণকারক তৈল বা গ্রিজ প্রয়োগ করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ সাইন বার (Sine Bar) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url