ডায়াবেটিস কমানোর উপায়
ডায়াবেটিস কি?
দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে রোগ হয় তা হলো ডায়াবেটিস বা বহুমুত্র রোগ। তখন রক্তে চিনি বা শকর্রার উপস্থিতিজনিত অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। ইনসুলিনের ঘাটতিই হলো এ রোগের মূল কথা। অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিন, যার সহায়তায় দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজকে নিতে সমর্থ হয় এবং একে শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে।
ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিনের কাজ করার ক্ষমতা-এর যেকোনো একটি বা দুটোই যদি না হয়, তাহলে রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজ। আর একে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঘটে নানা রকম জটিলতা, দেহের টিস্যু ও যন্ত্র বিকল হতে থাকে।
ডায়াবেটিসের ধরনঃ
১। টাইপ ১ ডায়াবেটিস (Insulin Dependent Diabetes, Juvenile Diabetes)
২। টাইপ ২ ডায়াবেটিস (Insulin Non Dependent Diabetes, Adult Onset Diabetes)
১। টাইপ ১ ডায়াবেটিস (Insulin Dependent Diabetes , Juvenile Diabetes): নাম দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারনত ছোট বয়সেই দেখা দেয় এবং প্রত্যহ ইনসুলিন গ্রহন ব্যাতিরেকে এর কোন চিকিৎসা নেই। (যত দিন বেঁচে থাকবে, ইনসুলিন নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে)
২। টাইপ ২ ডায়াবেটিস (Insulin Non Dependent Diabetes, Adult Onset Diabetes): টাইপ ২ ডায়াবেটিস বলতে আমরা সাধারনত ডায়াবেটিসকে বুঝাই, যার সূচনা ঘটে ৪০ বছর পরবর্তি সময়ে। এবং এই ডায়াবেটিস ই বংশ পরম্পরায় ছড়িয়ে পড়ে।
এর চিকিৎসার জন্য রয়েছে নানা ধরনের ঔষধ, যার ভেতর রয়েছে Oral Hypoglysemic Agents – Metformin, Glipizide, Repaglinide etc এই ঔষধ গুলো মুখে খাওয়ার জন্য, এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি খেতে হয়।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর আরেকটি ঔষধ হচ্ছে INSULIN- যখন উপরোক্ত ঔষধ গুলো আর কাজ করে না কিংবা liver diseases অথবা Surgery এর সময় এ Insulin দেয়া হয়।
ডায়াবেটিস এর লক্ষণঃ
১। ঘন ঘন প্রস্রাব। এ কারণে এ রোগটির নাম বহুমূত্র রোগ।
২। অধিক তৃষ্ণা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া।
৩। অতিশয় দুর্বলতা।
৪। সার্বক্ষণিক ক্ষুধা বা ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা।
৫। স্বল্প সময়ে দেহের ওজন হ্রাস বা ওজন কমতে থাকা।
৬। চোখে ঝাপসা দেখা।
৭। ঘন ঘন সংক্রমণ।
৮। ত্বক চুলকানি।
৯। দূর্বল আর ক্লান্ত অনুভব করা।
১০। পা অবশ বা ঝিন ঝিন করা।
১১। কাটা বা ঘা হলে ধীরে ধীরে সারা।
১২। ত্বকে ইনফেকশন।
১৩। মনসংযোগের অভাব হতে থাকা।
১৪। একটুতেই উত্তেজিত হওয়া বা মন খারাপ করা।
১৫। রাতে প্রস্রাবের কারণে ঘুম ভাঙ্গা।
১৬। বমি বমি ভাব হওয়া।
১৭। মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা হওয়া।
১৮। মিষ্টি খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া।
অনেক রোগীর ক্ষেত্রে উপরের কোনও লক্ষণই থাকে না। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এক বা একাধিক লক্ষণ থাকতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অন্য রোগের চিকিৎসা বা চেক-আপ করার সময়।
ডায়াবেটিস কমানোর উপায়ঃ
১। করল্লাঃ করল্লা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কারণ এটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে পারে। ইনসুলিনের নিঃসরণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে করল্লা। দুই বা তিনটি করল্লার বীচিগুলো ফেলে দিয়ে রস বের করে নিন। করল্লার রসের সাথে পানি মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট মাত্রায় করল্লার রস খেলে ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাবে,রক্তে ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়বে,অন্ত্রে গ্লুকোজের শোষণ কমে যাবে এবং রক্তে ক্ষতিকর চর্বির পরিমাণ কমে যাবে।
প্রতিদিন ১০০মিলি করল্লার রস সমান দুই ভাগে ভাগ করে দিনে দুই বার খাবেন খাওয়ার পর পর।এছাড়াও করল্লার রসের পাউডার পাওয়া যায় যা প্রতি কেজি দেহের ওজনের জন্য ১০০মিগ্রা হিসাবে পরিমাণ বের করে তাকে সমান দু ভাগে ভাগ করে দিনে দু’বার ভরা পেটে খাবেন।
২। দারুচিনিঃ যাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে তাদের জন্য দারুচিনি খুবই উপকারী। এটি অগ্নাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে এবং রক্তের সুগার লেভেল কমায়। দারুচিনির গুঁড়া চা বা পানি বা অন্য পানীয়ের সাথে মিশিয়ে পান করতে পারেন।
আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা কমিয়ে আনতে দারুচিনি খুব কার্যকরী। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা দারুচিনি গ্রহণ করার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেন।
৩। অ্যালোভেরাঃ অ্যালোভেরা জেলে ফাইটোস্ট্যারলস নামক শক্তিশালী উপাদান থাকে যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফাইটোস্ট্যারলসের অ্যান্টিহাইপার গ্লাইসেমিক প্রভাব আছে যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্য উপকারী। হলুদ, তেজপাতা ও অ্যালোভেরা জেল পানির সাথে মিশিয়ে দিনে দুইবার পান করুন।
৪। আম পাতাঃ ৩-৪ টি আম পাতা পানিতে ফুটিয়ে নিন। প্রতিদিন সকালে এই মিশ্রণটি খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে। আম পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে রাখতে পারেন। দিনে দুই বার আধা চামচ করে এই আম পাতার গুঁড়া খেতে পারেন।
৫। মেথিঃ ডায়াবেটিসের সবচেয়ে ভালো একটি প্রতিকার হচ্ছে মেথি। ২ টেবিল চামচ মেথি বীজ ১ গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রাখুন সারা রাত। সকালে মেথি বীজ সহ পানিটুকু পান করুন। মেথি বীজের জৈব উপাদান ইনসুলিনকে উদ্দীপিত করে। এছাড়াও এতে উচ্চ মাত্রার ফাইবার থাকে বলে স্টার্চকে গ্লুকোজে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ধীর করে যা ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সাহায্য করে।
মেথি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বীজ। মেথি দ্রবণীয় ফাইবার সমৃদ্ধ। এটি হজমে খুব সহায়ক। মেথি গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। প্রতিরাতে রাতে দুই টেবিল চামচ মেথি পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে পানি আলাদা করে খালি পেটে এই পানি পান করুন। এতে ডায়াবেটিসহ বিভিন্ন রোগের উপকার পাবেন।
৬। দারুচিনি খানঃ দারুচিনি তেল বা পাউডার আকারে নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে ৪৮%! গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দারুচিনির আছে অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা কমিয়ে আনার প্রাকৃতিক সক্ষমতা। আর এই দুটি উপাদান প্রাকৃতিক ভাবে কমিয়ে আনতে পারলে রক্তে সুগারের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে আসে।
৭। ধুমপান ত্যাগ করুনঃ স্ট্রেসের মতোই ধুমপানও নানা ধরনের মারাত্মক রোগের আরেকটি কারণ। ফুসফুস ক্যান্সার এর মতো ভয়ঙ্কর রোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিসেরও একটি কারণ ধুমপান। সুতরাং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে না চাইলে আজই ধুমপান ছেড়ে দিন।
৮। পূর্ণ শস্যজাতীয় খাদ্য খানঃ ওটমিল, বার্লি, ব্রাউন রাইস, ভুট্টা, বাজরা ইত্যাদি পূর্ণ শস্য জাতীয় খাদ্য দিয়ে সকালের নাস্তা করুন। পূর্ণ শস্য জাতীয় খাদ্যে আছে আঁশ, যা রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে সহায়ক। ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে। এছাড়া পূর্ণ শস্যজাতীয় খাদ্য কোষ্ঠকাঠিন্য, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগ থেকেও বাঁচাবে।
৯। প্রচুর হাঁটাহাঁটি করুনঃ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক সেরা ব্যায়ামগুলোর একটি হাঁটাহাঁটি। প্রতিদিন অন্তত ৪০মিনিট হাঁটাহাঁটি করলেই আপনার বিপাকীয় হার এমন পর্যায়ে থাকবে যা আপনার দেহে ইনসুলিনের মাত্রাকেও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখতে যথেষ্ট। ফলে ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকিও কমে আসবে।
১০। ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুনঃ আজকাল চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায় নানা ধরনের ফাস্টফুড। যা দেখে হয়তো লোভ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু ফ্রাইস, পিজ্জা, বার্গার এর মতো ফাস্ট এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে স্থুলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, হজমে সমস্যা এবং হৃদরোগের মতো নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এসব খাবার দেহে ইনসুলিনের মাত্রায়ও ক্ষতিকরভাবে হেরফের ঘটিয়ে দিতে পারে। যা থেকে ডায়াবেটিসও হতে পারে।
১১। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুনঃ মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগও হতে পারে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে। সুতরাং আপনি যদি এমন কেউ হন যিনি প্রায়ই তীব্র মানসিক চাপে থাকেন তাহলে রিল্যাক্স করার নানা কৌশল এবং যোগ ব্যায়াম করে স্ট্রেস কমান। এতে আপনার দেহে কর্টিসোল হরমোনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাবে।
১২। সালাদ খানঃ প্রতিদিন অন্তত এক বাটি সালাদ খান। যার মধ্যে থাকবে গাজর, শসা, লেটুস, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। প্রতিদিন দুপুরে বা রাতে খাবার খাওয়ার আগে এই সালাদ খেতে হবে। সালাদে এক চা চামচ ভিনেগারও যুক্ত করতে পারেন। ভিনেগার রক্তকে কমমাত্রায় সুগার শোষণে সহায়তা করে। আর রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমবে।
১৩। স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখাঃ দেহের ওজন স্বাস্থ্যকর মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত রাখার মধ্য দিয়ে শুধু ডায়াবেটিসই নয় বরং আরো নানা ধরনের রোগ বালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়। স্বাস্থ্যকরভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৭০% কমে আসবে।
১৪। ডুমুরের পাতাঃ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ডুমুর পাতা ব্যবহার খুব উপকারী। যদিও এটি তেমন প্রচলিত প্রতিষেধক নয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী প্রতিদিন সকালে নাশতার সাথে ডুমুর পাতার রস গ্রহণ করতে পারেন। অথবা ডুমুরের পাতা পানিতে সিদ্ধ করে সেই পানি চা আকারে পান করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১৫। জিরাঃ প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা পত্রে দাবী করা হয়েছে যে জিরা ১)রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায় ২)রক্তে চর্বির মাত্রা কমায় ৩)ডায়াবেটিক জটিলতার জন্য দায়ী AGE(Advanced Glycated End-product) তৈরীতে বাঁধা দেয়। কোন কোন গবেষক দাবী করেছেন জিরা’র কার্যকারিতা বহুল ব্যবহৃত ডায়াবেটিসের ঔষধ Glibenclamide(যেমন Dibenol) এর সমতুল্য।
আধা চা-চামচ সদ্য গুড়াকৃত জিরা পানি বা চায়ের সাথে মিশিয়ে খেতে হবে সকালে নাস্তার আগে ও রাতের খাবারের আগে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা মনে রাখতে হবে যে জিরার কিউমিন অ্যালডিহাইড বাতাসের অক্সিজেনের সাথে দ্রুত বিক্রিয়া করে নষ্ট হয়ে যায়।কাজেই ঔষধীগুণ পেতে তাৎক্ষণিকভাবে গুড়াকৃত জিরাই ব্যবহার করতে হবে।
১৬। আঙ্গুরের বীজের রসঃ আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে আঙ্গুরের বীজ ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিদিন ৫০ গ্রাম আঙ্গুরের বীজের রস গ্রহণ করলে রক্তে সুগারের মাত্রা আশানুরূপ ভাবে কমতে থাকে।
১৭। অলিভ অয়েলঃ অলিভ অয়েলের একগাদা গুনের মধ্যে একটি অন্যতম গুণ হল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক কাপ অলিভ অয়েল পান করলে ডায়াবেটিস আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
১৮। নয়নতারা ফুলঃ নয়নতারা খুব পরিচিত একটি ফুল। এ ফুলগাছের সব অংশই তেতো। প্রতিদিন সকালে দু’টি পাতা খালি পেটে চিবিয়ে খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ থাকে।
১৯। নিম ও তুলসিঃ তুলসি অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং নিম পাতার রয়েছে ওষুধি বৈশিষ্ট্য। নিমপাতা ও তুলসি পাতা ডায়াবেটিস নিরাময়ে ভালো কাজে দেবে। পাঁচটি পুদিনা পাতা ও নিমপাতা পানিতে ধুয়ে খালি পেটে চিবিয়ে খেলে ভালো উপকার পাবেন।
২০। কালো জামঃ কালো জাম গ্রীষ্মকালীন ফল। এটি রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবচেয়ে ভালো ফল হিসেবে অন্যতম।
২১। ঢেঁড়সঃ ঢেঁড়স ফাইবারসমৃদ্ধ সবজি। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস নিরাময় করতে রাতে এক গ্লাস পানির মধ্যে একটি ঢেঁড়স কেটে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে গ্লাস থেকে ঢেঁড়স তুলে খালি পেটে এই পানি পান করুন।
২২। মিষ্টি কুমড়াঃ মিষ্টি কুমড়া অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি সবজি। ডায়াবেটিক রোগীরা এ সবজি খেলে তাদের ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তাছাড়া মিষ্টি কুমড়ায় প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। ফলে চোখের সমস্যা দূর করে ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।
২৩। নিয়মিত ব্যায়ামঃ প্রতিদিন ব্যায়াম করুন। শারীরিক কার্যক্রম দেহে টিস্যুর সংবেদনশীলতা বাড়াতে কাজ করে এবং ওজন ঠিক রাখে। ব্যায়াম রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকরী। তবে ব্যায়াম শুরুর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২৪। তাজা খাবার খানঃ চেষ্টা করুন তাজা খাবার খেতে। কারখানায় খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় অনেক খাবারের মান নষ্ট হয়ে যায় বা কমে যায়। বেশি করে ফল, সবজি, মাছ, মাংস এবং বাদাম খাওয়া ভালো। এসব খাবার কার্বোহাইড্রেট, শর্করা এবং চর্বিকে পরিশোধিত করে। এসব খাবার ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
২৫। ভালোমতো ঘুমঃ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভালো করে ঘুমানো খুব জরুরি। ঘুমের সমস্যার কারণে ওজনাধিক্য এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ঘুম কেবল এসব সমস্যাই নয়, মস্তিষ্ক শিথিল করে মানুষকে কর্মক্ষম রাখতেও সাহায্য করে।
২৬। চাপ দূর করতে মেডিটেশনঃ চাপ থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত মেডিটেশন করুন। করটিসল, এপিনেফ্রিন এবং গ্লুক্যাজন এসব হরমোন বেড়ে যায় চাপের কারণে। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যায়।
২৭। কফি পান করুনঃ বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন অন্তত দুই কাপ কফি পান করলে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে ২৯%। তবে চিনি ছাড়া কফি পান করতে হবে। কফিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান এই কাজ করে।
এছাড়াও কারিপাতা, অ্যাপেল সিডার ভিনেগার, আমলকী, পেয়ারা ইত্যাদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকাঃ
ওষুধ ছাড়াই ডায়াবেটিস কমানোর উপায়ঃ
শরীরে অগ্ন্যাশয় যদি যথার্থ ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীরে ইনসুলিনের সঠিক কাজ ব্যাহত হয় তাহলে সেটাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। অধিক তৃষ্ণার্ত অনুভব করে এবং বার বার মুখ শুকিয়ে যায়। আক্রান্তরা অতিশয় দুর্বলতা, সার্বক্ষণিক ক্ষুধা, স্বল্প সময়ে দেহের ওজন হ্রাস, চোখে ঝাপসা দেখাসহ নানান সমস্যায় ভোগে।
ডায়াবেটিস নির্দিষ্ট মাত্রার বেশী হয়ে গেলে তা শরীরের ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণে রাখাই সর্বোত্তম পস্থা। এ জন্য প্রয়োজন কঠোর নিয়মানুবর্তিতা। এর পাশাপাশি কিছু খাবারও ডায়াবেটিস রোগীকে সুস্থ্য থাকতে সহায়তা করে। আবার কিছু খাবার আছে যেগুলো ডায়াবেটিস প্রতিরোধও করে। যেমনঃ
১। সবুজ চাঃ সবুজ চা মানুষের শরীরে ইনসুলিনের মতো কাজ করে; ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে এটি।
২। মাছঃ গবেষণায় দেখা যায়, মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ইনসুলিনের সংবেদনশীলতাকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি গ্লুকোজের ঘনত্ব কমিয়ে ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করে। এতে চর্বিহীন প্রোটিন রয়েছে।
৩। টক দইঃ টক দই একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য। এতে চিনির পরিমাণ খুব কম। এটি রক্তে চিনির পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। দুপুরের খাবারের সঙ্গে বা বিকেলের নাস্তায় স্যান্ডউইচের সঙ্গে টক দই খাওয়া যায়। এটি ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৪। ডিমের সাদা অংশঃ ডিম পেশি গঠনকারী খাদ্য। এতে উচ্চ মানের প্রোটিন রয়েছে। ডিমের সাদা অংশে উচ্চ মানের চর্বিহীন প্রোটিন এবং কম মাত্রায় কার্বোহাইড্রেট রয়েছে যা ২ ধরণের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৫। লেবুঃ লেবু ও লেবু জাতীয় ফল ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরে ভিটামিন সি এর অভাবে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। তবে লেবু জাতীয় ফল খেলে ভিটামিন সি এর অভাব পূরণ হয়। জাম্বুরা, কমলা, লেবু এবং লাইমস ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিনের মতো কাজ করে।
৬। সবুজ শাক সবজিঃ সবুজ শাক সবজি ২ ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায়। পালং শাক, পাতা কপি, শালগম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুস পাতা ইত্যাদি খাবারে ক্যালরি এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম। গবেষণায় বলা হয়, সবুজ শাক সবজি খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে।
৭। শস্য দানাঃ প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শস্য দানা মানুষের শরীরের রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা কমে। আবার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে শস্য দানা।
৮। বাদামঃ গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসের ঝুকি প্রায় ২১ শতাংশ পর্যন্ত কমায় চীনাবাদাম। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ১ আউন্স আখরোট বা কাজুবাদাম ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিস্ময়করভাবে কাজ করে। নিয়মিত বাদাম খেলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে।
৯। মটরশুটিঃ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি খাদ্য মটরশুটি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ১ কাপ মটরশুটি খেলে ২ ধরনের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। এতে উচ্চমাত্রায় শর্করা, চর্বিহীন প্রোটিন এবং আঁশ রয়েছে। এটি শরীরের রক্তে চিনি কমাতে সাহায্য করে; হৃদরোগের সম্ভাবনাও কমায়।
১০। ওয়াইল্ড স্যামনঃ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অন্যতম একটি ঔষধি খাদ্য ওয়াইল্ড স্যামন। এতে উচ্চ মাত্রায় ওমেগা-৩ রয়েছে। ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি বড় উৎস এটি। ডায়াবেটিস রোগের পাশাপাশি কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকিও কমায় ওয়াইল্ড স্যামন।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে এবং ডায়াবেটিস-এর জটিলতামুক্ত সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে নিচের টিপসগুলো মেনে চলা প্রয়োজনঃ
১। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করুন।
২। অতিরিক্ত লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবার যথাসম্ভব পরিহার করুন। প্রতিদিন কিছু পরিমাণ শাক-সবজি ও ফলমূল খান।
৩। ফাস্ট-ফুড এবং কোল্ড-ড্রিংক্স পরিহার করুন।
৪। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত রিচ ফুড যথাসম্ভব পরিহার করুন।
৫। ওজন নিয়ন্ত্রণের চমৎকার একটি উপায় হচ্ছে হাঁটা। তাই কম দূরত্বের জায়গাগুলোতে হেঁটে চলাচল করুন।
৬। লিফ্ট-এর বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
৭। একটানা অধিক সময় বসে কাজ করবেন না। কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান। একটু পাঁয়চারি করুন।
৮। অলসতা দূর করতে সংসারের টুকিটাকি কাজ নিজেই করুন। সুযোগ থাকলে বাগান করুন, খেলাধুলা করুন। সাঁতার কাটুন।
৯। সপ্তাহে তিন/চার দিন কিছু সময় ফ্রি-হ্যান্ড (যন্ত্র ছাড়া) ব্যায়াম করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার উপযুক্ত ব্যায়াম নির্বাচন করুন। কারণ সব ব্যায়াম সবার জন্য উপযুক্ত নয়। ব্যায়াম করছেন এ ধারণা মাথায় রেখে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করবেন না।
১০। কোমড়ে চওড়া বেল্ট ব্যবহার করতে পারেন। এতে মেদ দ্রুত বাড়তে পারবে না।
১১। প্রচলিত বিজ্ঞাপনের চমকে আকৃষ্ট হয়ে দ্রুত চিকন হওয়ার ওষুধ বা যন্ত্র ব্যবহার করতে যাবেন না। এতে আপনার অমঙ্গলের আশংকাই বেশী।
১২। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতে আপনার মুটিয়ে যাওয়ার মাত্রা নির্ণয় করে বয়সানুসারে সুষম খাদ্যের তালিকা তৈরী করুন।
১৩। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
১৪। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমত চিকিৎসা গ্রহণ করুন। ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্যগ্রহণ তথা সার্বিক জীবনযাপন সংক্রান্ত তার সুনির্দিষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশনা (যা শুধুমাত্র আপনার জন্য প্রযোজ্য) মেনে চলুন।
১৫। প্রতিদিন সকালে সূর্যের আলোয় কিছুক্ষণ হাঁটলে শরীরে ভিটামিন ডি এর উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ইনসুলিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভিটামিন ডি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
১৬। সারাদিনে প্রচুর পানি পান করুন। পানি চিনিকে ভাংতে সাহায্য করে।
১৭। দম চর্চা করে, গান শুনে বা শখের কাজ করে স্ট্রেস মুক্ত থাকুন। কারণ স্ট্রেস ব্লাড সুগার বৃদ্ধি করে।
১৮। আঁশযুক্ত খাবার খান।
১৯। নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খান।
২০। নিয়মিত ব্লাড সুগার লেভেল মাপুন।
২১। ডায়াবেটিসের রোগীদের স্ট্রেস ও উদ্বিগ্নতা কমানোর জন্য নিয়মিত ৮ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। স্ট্রেস ও উদ্বিগ্নতা ডায়াবেটিসের প্রাথমিক কারণ।
ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকাঃ
ডায়বেটিসের সমস্যা ইদানীং অনেক বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতি ঘরেই ডায়াবিটিসের রোগী দেখা যায়। ডায়বেটিস রোগীদের অনেক বেশি সাবধানতা প্রয়োজন। কিছু খাবার খাওয়া ডায়াবিটিস রোগীদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।
আসুন জেনে নেয়া যাক এমনই কিছু ক্ষতিকর খাবার সম্পর্কে।
১. সাদা চালঃ সাদা চালের ভাত যতো বেশি খাওয়া হয় ততো বেশি টাইপ-২ ডায়াবিটিসের আশঙ্কা বেড়ে যায়। প্রায় ৩,৫০,০০০ মানুষের উপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রতিদিন সাদা চালের ভাত নিয়মিত খাওয়ার ফলে প্রায় ১১% টাইপ-২ ডায়বেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। তাই রোগীরা কতোটুকু ভাত খাওয়া স্বাস্থ্যকর তা জানতে নিজের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।
২. চাইনিজ খাবারঃ চাইনিজ খাবারে রয়েছে অনেক বেশি ফ্যাট, ক্যালরি, সোডিয়াম, কার্বোহাইড্রেট যা হুট করেই দেহের সুগারের মাত্রা অনেক বেশি বারিয়ে তোলে। বিশেষ করে অরেঞ্জ, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার ধরণের খাবার ডায়াবিটিস রোগীদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।
৩. বোতলজাত ফলের জুসঃ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে সোডা বাদ দিয়ে ফলের জুস পান করেন? কিন্তু জেনে রাখুন বোতলজাত ফলের জুস পান করা এবং সোডা পান করার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। কারণ ফলের জুসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও ক্যালরি যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
৪. কলা ও তরমুজঃ সবাই জানেন তাজা ফলমূল স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর, কিন্তু ডায়বেটিস রোগীদের জন্য তাজা সব ফল স্বাস্থ্যকর নয়। কলা এবং তরমুজের মতো ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি যা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ায়। তাই এই খাবারগুলো থেকে দূরে থাকাই ভালো।
৫. রিফাইন্ড সিরিয়ালঃ সুইটেন্ড ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল ধরণের খাবারগুলো ডায়াবিটিস রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়াও ইনস্ট্যান্ট ধরণের স্বাস্থ্যকর ওটমিলও ডায়াবিটিস রোগীদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। উপাদেয় সিরিয়াল রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সিরিয়ালের কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা একেক জনের দেহে একেকভাবে দেখা দিতে পারে। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের এড়িয়ে চলাই ভালো। এর পরিবর্তে সবজি ও ডিমের সাদা অংশ খেতে পারেন। তবে ডিমের কুসুমে কোলেস্টরেল রয়েছে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৬. ঘন দুধের তৈরি কোন খাবারঃ দুধ খাওয়া ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভাল। কিন্তু কিছু খাবার যাতে দুধের পরিমাণ খুব বেশি যেমনঃ- দই, দুধের তৈরি ক্রিম, চিজ এই খাবার গুলো ডায়াবেটিক রোগীদের না খাওয়াই উত্তম।
৭। চর্বিসমৃদ্ধ মাংসঃ ডায়াবেটিস রোগীরা হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকেন। চর্বিযুক্ত মাংস পুষ্টিকর হলেও এতে প্রচুর পরিমাণে সম্পৃক্ত ফ্যাট রয়েছে, যা এসব রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এর বদলে প্রোটিনসমৃদ্ধ বিন, লেনটিস ইত্যাদি থেকে পারেন। তাছাড়া মাছ ও সামুদ্রিক খাবারও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
৮। এনার্জি বারঃ এনার্জি বারে চকোলেট, কার্ব এবং চিনি উপাদান থাকে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের এটিও এড়িয়ে চলা উচিত। এর বদলে ক্ষুধা লাগলে বাড়িতে তৈরি স্ন্যাক্স খেতে পারেন।
৯। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইঃ এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেশ মারাত্মক খাবার। একটু বেশি পরিমাণ খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন এটিকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।
১০। পাস্তা আলফ্রেডোঃ আলফ্রেডো সস ক্রিম, পারমেসান চিজ এবং বাটার থেকে তৈরি হয়। এতে রয়েছে ১ হাজার ক্যালরি, ৭৫ গ্রাম ফ্যাট এবং ১০০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট। তাই এটিও বাদ দেওয়া জরুরি। এর পরিবর্তে গমের তৈরি পাস্তা খেতে পারেন টমেটো সস দিয়ে। এতে রয়েছে ২৮০ ক্যালরি এবং ১৪ গ্রাম ফ্যাট।
১১। ফলের রসঃ সকালের নাস্তায় ফলের রস খুব স্বাস্থ্যকর হলেও তা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য হুমকি। তাছাড়া দোকানে পাওয়া যায় এমন ফলের রসে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে। তাই এর বদলে কম সুগার রয়েছে এমন ফলের একটি বা দুটি টুকরো খেতে পারেন।
১২। ট্রেইল মিক্সঃ সংরক্ষণ করা হয় এমন ট্রেইল মিক্সে বাদাম, শুকনো ফল এবং মিল্ক চকলেট রয়েছে। এদের মধ্যে বাদাম ছাড়া বাকিগুলো ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য হুমকি। তাই এর পরিবর্তে নিম্নমাত্রার কার্বযুক্ত সূর্যমুখীর বীচি, ওয়ালনাট, রোস্টেড পিনাট এবং আলমন্ড দিয়ে ট্রেইল মিক্স বানাতে পারেন। এই মিক্স কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ পাউরুটি দিয়ে খেতে পারেন।
১৩। ফ্রুট স্মুথিঃ এসব খাবারের নাম শুনলে মনে হয় খুবই স্বাস্থ্যকর। কিন্তু এটি চিনিতে পরিপূর্ণ। তাই খেতে মন চাইলে বাড়িতে চিনি ছাড়া তৈরি করে উপভোগ করুন।
১৪। পেস্ট্রিঃ ডোনাট, টোস্ট বা পেস্ট্রির মতো মজার খাবার ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভয়ংকর হতে পারে। এসব খাবার প্রক্রিয়াজাত সাদা চাল থেকে তৈরি হয় যাতে উচ্চমাত্রার ফ্যাট, কার্ব এবং সোডিয়াম রয়েছে। বরং এসব খাবারের পরিবর্তে বাদামী চালের তৈরি কেক খান। কম চিনি রয়েছে এমন পিনাট বাটার ব্যবহার করুন।
১৫। কলা এবং তরমুজঃ সব তরতাজা ফলেই ভিটামিন ও ফাইবার রয়েছে। কিন্তু কলা ও তরমুজের পুষ্টিগুণ ভালো থাকলেও এসব ফলে গ্লুকোজের পরিমাণ প্রচুর। তাই এসব খাবারের পরিবর্তে ব্লুবেরি এবং বেরি জাতীয় ফল বেশি বেশি খান।
১৬। ব্লেন্ডেড কফিঃ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সিরাপ, সুগার এবং ক্রিম সমৃদ্ধ ব্লেন্ডেড কফি মারাত্মক ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়। কেননা এর ব্লেন্ডেড সংস্করণে রক্তে গ্লুকোজ বাড়ানোর উপাদান প্রচুর রয়েছে। এক কাপ ব্লেন্ডেড কফিতে ৫০০ ক্যালরি, ৯৮ গ্রাম কার্ব এবং ৯ গ্রাম ফ্যাট থাকে। তাই এর পরিবর্তে নন-ফ্যাট সংস্করণ কফি বেছে নিন।
ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়ঃ
অধিক সময়ের জন্য রক্তে হাই গ্লুকোস টকসিক৷ সময়ের সাথে সাথে রক্তের হাই গ্লুকোস ব্লাড ভেসেলগুলির ক্ষতি করে, মূত্রাসয়, চোখ, নার্ভ এর ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকে এবং শরীরের প্রমুখ অঙ্গগুলির চিরতরের জন্য অকেজো হয়ে যেতে পারে৷ নিউরোপ্যাথি নার্ভের রোগ হলে পা অথবা অন্য অঙ্গগুলি অবশ হতে পারে৷
আর্টেরিওসিরোলিসিস ব্লাড ভেসেল এর রোগ যার কারণে হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক, রক্ত সঞ্চালনের অসুখ হতে পারে৷ চোখের সমস্যা হতে পারে যাতে ব্লাড ভেসেল ড্যামেজ হতে পারে যাকে বলে রেটিনোপ্যাথি, চোখের প্রেসারের সমস্যা যার নাম গ্লুকোমা এবং চোখের মনির চারপাশে ঘোলাটে হয়ে যাওয়া যার নাম ক্যাটারাক্ট(চোখে ছানি পরা)৷
নেফরোপ্যাথি মূত্রাশয়ের (কিডনি)রোগ যার ফলে কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ আলাদা করতে পারে না ৷ হাইপারটেনসান, হাই ব্লাড প্রেসার যার ফলে হৃতপিণ্ড রক্ত সঞ্চালন করার জন্য স্বাভাবিকের থেকে অনেক জোরে জোরে কাজ করে৷
ডায়াবেটিস কমানোর ওষুধঃ
1. Metformin: প্রথম শ্রেনীর চিকিৎসা হিসাবে Metformin ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের ঔষধ ইনসুলিন প্রবেশের বাধা থাকলে সেটাকে উন্মুক্ত করতে সাহায্য করে থাকে। নিজের ভিতরে থেকে ইনসুলিনকে কাজে লাগিয়ে দেহ শক্তি পেয়ে থাকে। তাই মেটফরমিনকে প্রথম শ্রেনীর ঔষধ বলা হয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য।
2. Sulfonylureas: প্যাংক্রিয়াসের বিটা কোষ ইনসুলিন উৎপাদনে ব্যর্থ হলে এটাকে ৩য় চিকিৎসা পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। এই ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়কে বা প্যাংক্রিয়াসকে উত্তেজিত করে ইনসুলিন নিঃসৃত করতে সাহায্য করে। Sulfonylureas ড্রাগের মধ্যে gliclazide, glipizide, glimepiride, tolbutamide and glibenclamide ইত্যাদি নামে বাজারে পাওয়া যায়।
তবে এই ধরনের চিকিৎসায় প্যাংক্রিয়াস যথেষ্ট পরিমান ইনসুলিন নির্গত করে। তবে এই ঔষধ ধীরে ধীরে বিটা সেলের কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে থাকে। তবে ঔষধের টাইট্রেশন করা দরকার এবং প্রতিনিয়ত রক্তে সুগারের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। যেকন সময়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।
ডায়াবেটিস চিকিৎসা নেয়ার আগে নিজেকে এই বিষয় ভালভাবে জানতে হবে। তবে সহজেই নিজেই এটাকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। নিজেকেই রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে যেকোন ওরাল ড্রাগ সেবন করবেন।
ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও প্রতিকারঃ
ইনসুলিনঃ
ইনসুলিন গ্রহনের মাধ্যমে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন রয়েছে, এটা গ্রহনের নির্ভর করে কত তাড়াতাড়ি কাজ করে। ইনসুলিন গ্রহন করা একটা সিরিঞ্জের মাধ্যমে, পেন ইনসুলিনের মাধ্যমে অথবা পাম্প ইনসুলিনের মাধ্যমে। বিভিন্ন প্রকারের ইনসুলিন এর কার্যকারিতা বিভিন্ন ধরনের। নিচে ইনসুলিনের প্রকারগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হল।
ইনসুলিনের প্রকারভেদঃ
ইনসুলের এক্টিং এর উপর নির্ভর করবে কিভাবে গ্রহন করতে হবে। কিছু ইনসুলিন আছে যেগুলো দ্রুত কাজ করে, কিছু দেরিতে করে, কিছু ইন্টারমিডিয়েট, বাকি কিছু আছে যা লং একটিং হিসাবে কাজ করবে। তাই ইনসুলিন গ্রহনের পূর্বে কোনটা কোন প্রকৃতির সেই বিষয়ে জানতে হবে।
১। র্যাপিড-এক্টিং ইনসুলিনঃ
এই টাইপের ইনসুলিন খাবার আগে অথবা খবারের সাথে গ্রহন করতে হয়। ইনসুলিন গ্রহনের সাথে সাথে রক্তে সুগারের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। তাই এই ধরনের ইনসুলিন গ্রহনের সময় ঘনঘন রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করা হয়। বাজারে র্যাপিড একটিং ইনসুলের মধ্যে যেগুলো বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো হল- Asparat, Glulisine, Lispro ইত্যাদি টাইপের ইনসুলিন।
২। শর্ট একটিং ইনসুলিনঃ
এই ধরনের ইনসুলিন খাবার আগে সিরিঞ্জের মাধ্যমে গ্রহন করা হয়। এটা র্যাপিড ইনসুলিনের চেয়ে কম কার্যকারি এবং ধীরে ধীরে রক্তের সুগারের মাত্রা হ্রাস করে থাকে। এই ধরনের ইনসুলিন সবার ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য নয়। সে সকল ইনসুলিন শর্ট একটিং হিসাবে কাজ করে তার মধ্যে অন্যতম Actrapid, Humulin R, Insuman Rapid ইত্যাদি পাওয়া যায়।
৩। ইন্টারমিডিয়েট ইনসুলিন এক্টিংঃ
এই ধরনের ইনসুলিন শর্ট এক্টিং ও র্যাপিড এক্টিং ইনসুলিনের চেয়ে আলাদা একটা ইনসুলিন। এই ইনসুলিনের কার্যকারিতা র্যাপিড একটিং থেকে কম কিন্তু শর্ট এক্টিং থেকে বেশি হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শর্ট এক্টিং ইনসুলিনের সাথে ইন্টারমিডিয়েট ইনসুলিন দেয়া হয়ে থাকে। ইন্টারমিডিয়েট ইনসুলিন ইনজেকশনের ১ ঘন্টার মধ্যে কাজ শুর করে। ইনজেকশনের পর থেকে ৭ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ীত্ব থাকে। Humulin NPH, Protaphane, Insulatard ইত্যাদি বাজারে ইন্টারমিডিয়েট ইনসুলিন।
৪। লং অ্যাক্টিং ইনসুলিনঃ
এই টাইপের ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই ধরনের ইনসুলিন ধীরে ধীরে রিলিস হয়ে থাকে। এই ধরনের ইনসুলিন সকালে অথবা বিকালে গ্রহন করতে হয়। লং অ্যাক্টিং ইনসুলিনের মধ্যে Detemir, Glargine বাজারে পাওয়া যায়।
প্রতিটি ইনসুলিন গ্রহনের সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। বাইরে থেকে ইনসুলিন গ্রহন করলে ঘনঘন গ্লূকোজ মনিটরিং করতে হয়। ঘনঘন মনিটরিং না করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। এমনকি, অত্যাধিক হারে গ্লূকোজের মাত্রা হ্রাস পেলে মৃত্যু হতে পারে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধঃ
ডায়াবেটিস রোগে প্রতিরোধ বলতে সুস্পষ্টভাবে তিন ধরনের বা তিনটি ধাপে প্রতিরোধ করার কথা বলা হয়। প্রথমটি হচ্ছে প্রাথমিক প্রতিরোধ বা প্রাইমারি প্রিভেনশন। অর্থাৎ রোগ হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করা। এ জন্য চাই সামাজিক সচেতনতা। ছোটবেলা থেকেই সবুজ শাকসবজি, মাছ ও কম চর্বি-শর্করাযুক্ত খাদ্য গ্রহণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
ধূমপানের বিরুদ্ধে যেমন গণসচেতনতা গড়ে উঠেছে, তেমনিভাবে মন্দ খাদ্যাভ্যাসের বিরুদ্ধেও সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। শিশু, কিশোর ও বয়স্ক সবার মধ্যেই কায়িক শ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খেলার মাঠ ছাড়া কোনো স্কুল-কলেজ থাকতে পারবে না। পাড়ায় পাড়ায় চাই পার্ক বা খোলা জায়গা, চাই হাঁটার উপযোগী ফুটপাত, সর্বোপরি নিরাপদে হাঁটার পরিবেশ।
এই সচেতনতা গড়ে তুলতে পাঠ্যপুস্তকে সঠিক জীবনাচরণ সম্পর্কে তথ্য অন্তর্ভুক্তি, মিডিয়ার ব্যবহার, শিক্ষক-ধর্মীয় নেতা-সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ, সমাজকর্মীদের সচেতন করে তোলা, সচেতনতা ক্যাম্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিরোধের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান।
রোগের লক্ষণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে অবগতি, কখন কেন রক্তের চিনি পরীক্ষা করা জরুরি, শনাক্তকরণ পরীক্ষার সহজলভ্যতা ও ব্যয় সংকোচন এই বিষয়গুলো সেকেন্ডারি প্রিভেনশনের আওতায় পড়ে। চল্লিশ-পরবর্তী সব নাগরিকের অন্তত তিন বছর পরপর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা জরুরি।
স্থূলতা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি ঝুঁকি থেকে থাকলে বছরে একবার। গর্ভবতী হওয়ার পর অবশ্যই প্রতিবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু করলে অনেক জটিলতাই এড়ানো সম্ভব। তৃতীয় ধাপে আছে যাদের ইতিমধ্যে জটিলতা দেখা দিয়েছে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া ও আরও জটিলতা এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
ডায়াবেটিস নীরবে রোগীর চোখ, রক্তনালি, হার্ট, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র ও পদযুগলের ভয়ানক ক্ষতি করে থাকে। জটিল রোগীদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা ও পুনর্বাসন করাও ডায়াবেটিস চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।আসুন, সবাই মিলে কাজ করি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা একটি সমন্বিত, সামাজিক পদক্ষেপ।
সরকার, চিকিৎসক, কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারও একার পক্ষে কখনো এই বিপুল কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সমাজের প্রতি স্তরে, পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে একে প্রতিরোধ করার জন্য। আসুন, একটি সুস্থ, কর্মোদ্যম ও প্রাণবন্ত জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাই মিলে এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ
ডায়াবেটিস স্বল্পকালীন চিকিৎসায় পুরোপুরি সেরে যাওয়ার মত অসুখ নয়। এটিকে সারা জীবন ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধ ছাড়া নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামই কখনও কখনও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট। যে কয়টি অসুখ মানুষের দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তীর সৃষ্টি করে তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে ডায়াবেটিস-এর উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। ইনসুলিনের অভাব হলে শরীরে শর্করা, আমিষ এবং চর্বিজাতীয় খাবারের বিপাক যথাযথভাবে সংঘটিত হতে পারে না। এতে শরীরে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট-এর স্বাভাবিক সমতাও বিনষ্ট হয়। দীর্ঘমেয়াদী অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের প্রায় প্রতিটি তন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কিডনী, হ্নৎপিন্ড, চোখ, কান, ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র, অস্থিসন্ধি এবং প্রজননতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যহত করে থাকে। ডায়াবেটিস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কখনও কখনও স্ট্রোক, অন্ধত্ব অঙ্গহানি কিংবা মৃত্যুর মত মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে।
সংক্রামক রোগের মত ডায়াবেটিস-এর সুনিদিষ্ট কোন কারণ জানা যায়নি। তবে বংশগতি বা পারিবারিক প্রবণতা, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, অধিক মাত্রায় খাদ্যগ্রহণ, মুটিয়ে যাওয়া, রক্তে ক্ষতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, কম শারীরিক পরিশ্রম তথা সার্বিক জীবন-যাপনের ধরনের সঙ্গে ডায়াবেটিস-এর নিবীড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। পূর্বে উল্লিখিত বিষয়গুলো ডায়াবেটিস-এর ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে ওজন বেড়ে যাওয়াকে ডায়াবেটিস-এর অন্যতম প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরা হয়।
তাই জীবন যাপনের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডায়াবেটিস-এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের একটি পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে চিকিৎসার পাশাপাশি এর প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অধিকমাত্রায় ক্লান্তি বোধ করা ডায়বেটিসের সাধারণ উপসর্গ। কখনও কখনও ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও এসব উপসর্গ অনুপস্থিত থাকতে পারে।
কারও ডায়বেটিস-এর লক্ষণ থাকলে কিংবা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারও ডায়াবেটিস থাকলে রেজিষ্টারড চিকিৎসকের পরামর্শ মত ডায়াবেটিস নির্ণয়ের ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করতে হবে। এতে আগেভাগে ডায়াবেটিস নির্ণয় করে এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে ডায়াবেটিস-এর মারাত্মক সব জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে। ডায়াবেটিস-এর কারণ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
কার্যকর স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ তথা সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতি বছর ২৮শে ফেব্রুয়ারি “জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস” হিসেবে পালিত হয়। এ দিবসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করে এর প্রতিরোধ এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন করা।
ডায়াবেটিস স্বল্পকালীন চিকিৎসায় পুরোপুরি সেরে যাওয়ার মত অসুখ নয়। এটিকে সারা জীবন ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধ ছাড়া নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামই কখনও কখনও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট।
এর সাথে কারও কারও মুখে খাওয়ার ওষুধ-এর প্রয়োজন হয়। কারও আবার প্রয়োজন হয় ইনসুলিন ইনজেকশনের। তবে সকল ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন আবশ্যক।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়ঃ
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসছে না! ডাক্তারের পরামর্শমত নিয়মিত ওষুধ সেবন করছি, ইনসুলিনও নিচ্ছি তার ওপর মুটিয়ে যাচ্ছি, কী করব? এ ধরনের প্রশ্ন অনেক রোগীর। কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার, এর পাশাপাশি খুব সহজ একটা কাজ করার আছে, সেটা হলো হাঁটা। প্রতিদিন এক ঘণ্টা (ষাট মিনিট) জোরে জোরে হাঁটা এবং অন্তত দুই মাইল হাঁটবেন। হাঁটার কোনো সময় নেই তবে সকাল অথবা বিকাল, যখন সূর্যের আলোর প্রখরতা কম থাকে তখনই হাঁটার সবচেয়ে ভালো সময়।
সুতরাং যখনই হাঁটুন, যতবার সম্ভাব হাঁটুন, দুই মাইল হাঁটতে হবে এবং এতে বেশ ভালো ফল পাওয়া যাবে। গবেষকদের মতে, যারা নিয়মিত অন্তত দুই মাইল হাঁটে তাদের বডি মাস ইনডেক্স কমে, শরীরের ওজন কমে শরীরটা হালকা লাগে, তলপেটের মেদ কমে এবং উন্নতি হয় ইনসুলিনের প্রতি দেহকোষের সংবেদনশীলতা। সর্বোপরি কমে যায় ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্কিত শরীরের অন্যান্য ঝুঁকি। তাছাড়া একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন দুই মাইল হাঁটলে ডায়াবেটিস রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে এবং এর প্রতিরোধও সম্ভব।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মেথি একটি গুরুত্ববহ প্রাকৃতিক পথ্য। মেথিকে মসলা, খাবার ও পথ্য তিনটিই বলা চলে। মেথি স্বাদে তিতা হলেও এতে রয়েছে রক্তে সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণের বিস্ময়কর শক্তি। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চামচ চিনি চিবিয়ে খেলে বা এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই পানি সকালে খালি পেটে পান করলে শরীরের রোগ জীবাণু মরে, রক্তে শর্করার মাত্রা কমে, রক্তের ক্ষতিকর চর্বির (কোলেস্টেরল) মাত্রা কমে, শরীরে কৃমি থাকলে মারা যায়, গরম জনিত ত্বকের অসুখাদি দূর হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সকালে মেথি খান তাদের ডায়াবেটিস জনিত অন্যান্য অসুখ কম হয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক কম থাকে। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মেথি হলো শ্রেষ্ঠ পথ্য তবে তার সঙ্গে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ট্যাবলেট বা ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে।
যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের জন্যও মেথি উপকারী। যেমনঃ মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধির জন্য, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, শরীরকে সতেজ রাখার জন্য, রক্তের উপাদানগুলোকে বেশি মাত্রায় কর্মক্ষম করার জন্য মেথি অত্যন্ত উপকারী। বার্ধক্যকে দূরে ঠেলে তারুণ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মেথি। নানাবিধ গুণসম্পন্ন এই মেথি আজ থেকেই হোক আমাদের সবার গুরুত্বপূর্ণ খাবার।
ডায়াবেটিস কমানোর জন্য প্রাকৃতিক চিকিৎসাঃ
বর্তমানে অনেকেই ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসা এর ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। রোগীদের এ আগ্রহের কারণেই সারাবিশ্বেই ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসা এর নানা ঔষধ ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আপনাদের কিছু ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসা গুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে যেগুলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং যেগুলোর কার্যকারিতা গবেষণাগারেও প্রমাণিত হয়েছে এবং বিভিন্ন জার্নালেও তা প্রকাশিত হয়েছে।
ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসা হিসেবে করল্লার রসঃ
প্রতিদিন নির্দিষ্ট মাত্রায় করল্লার রস খেলে ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাবে,রক্তে ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়বে,অন্ত্রে গ্লুকোজের শোষণ কমে যাবে এবং রক্তে ক্ষতিকর চর্বির পরিমাণ কমে যাবে।
নিয়মঃ প্রতিদিন ১০০মিলি করল্লার রস সমান দুই ভাগে ভাগ করে দিনে দুই বার খাবেন খাওয়ার পর পর।এছাড়াও করল্লার রসের পাউডার পাওয়া যায় যা প্রতি কেজি দেহের ওজনের জন্য ১০০মিগ্রা হিসাবে পরিমাণ বের করে তাকে সমান দু ভাগে ভাগ করে দিনে দু’বার ভরা পেটে খাবেন।
সতর্কতাঃ মাত্রাতিরিক্ত বা অন্যন্য ডায়াবেটিসের ঔষধের সাথে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অতিরিক্ত কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।কাজেই এ বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসা হিসেবে ডুমুরের পাতাঃ
স্পেনের গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে প্রতিদিন সকালে নাস্তার সাথে ডুমুরের পাতার চা খেলে ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিক রোগীদের দৈনিক ইনসুলিনের চাহিদা ১২% কমে যায় মাত্র এক মাসে। এছাড়াও ডুমুর পাতার চা পানে রক্তে ক্ষতিকর চর্বির মাত্রা কমে যায়। (সূত্র:ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন,ইউনিভার্সিটি হসপিটাল,মাদ্রিদ,স্পেন)।
ডুমুরের পাতার মূল উপাদানঃ পলিফেনল
কীভাবে কাজ করেঃ ডুমুরের পাতার চা পলিফেনল হুবহু ইনসুলিনের মত কাজ করে। জেনে নিন কীভাবে এই চা বানাবেনঃ আধা লিটার পানিতে ২ টেবিল চামচ শুকনা ডুমুরের পাতার গুড়া ছেড়ে দিন।এরপর ১৫মিনিট বা তার অধিক সময় ধরে ফুটান যাতে পানির পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যায়।এখন এই চা পান করুন নাস্তার সাথে।
সতর্কতাঃ মাত্রাতিরিক্ত বা অন্যন্য ডায়াবেটিসের ঔষধের সাথে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অতিরিক্ত কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।কাজেই এ বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসায় জিরার ব্যবহারঃ
প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা পত্রে দাবী করা হয়েছে যে জিরা ১)রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায় ২)রক্তে চর্বির মাত্রা কমায় ৩)ডায়াবেটিক জটিলতার জন্য দায়ী AGE(Advanced Glycated End-product) তৈরীতে বাঁধা দেয়। কোন কোন গবেষক দাবী করেছেন জিরা’র কার্যকারিতা বহুল ব্যবহৃত ডায়াবেটিসের ঔষধ Glibenclamide(যেমন Dibenol) এর সমতুল্য।
জারার মূল উপাদানঃ কিউমিন অ্যালডিহাইড (Cuminaldehyde).
কীভাবে কাজ করেঃ
১। জিরার কিউমিন অ্যালডিহাইড ক্ষুদ্রান্তের(পেটের নাড়ী-ভুড়ির অংশ) ভিতরের দেয়ালের কোষের আলফা-গ্লুকোসাইডেজ এনজাইমকে কাজ করতে বাঁধা দেয় ফলে পরিপাককৃত শর্করাজাতীয় খাদ্যের ওলিগোস্যাকারাইড মনোস্যাকারাইডে(গ্লুকোজ) পরিণত হতে বাঁধাগ্রস্থ হয়।
২। কিউমিন অ্যালডিহাইড অ্যালডোজ রিডাকটেজ এনজাইমকে বাঁধাদানের মাধ্যমে দেহের জন্য ক্ষতিকর ও ডায়াবেটিক জটিলতার জন্য দায়ী AGE(Advanced Glycated End-product) তৈরীতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।ফলে ডায়াবেটিসের নানাবিধ জটিলতা এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
নিয়মঃ আধা চা-চামচ সদ্য গুড়াকৃত জিরা পানি বা চায়ের সাথে মিশিয়ে খেতে হবে সকালে নাস্তার আগে ও রাতের খাবারের আগে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা মনে রাখতে হবে যে জিরার কিউমিন অ্যালডিহাইড বাতাসের অক্সিজেনের সাথে দ্রুত বিক্রিয়া করে নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই ঔষধীগুণ পেতে তাৎক্ষণিকভাবে গুড়াকৃত জিরাই ব্যবহার করতে হবে।
সতর্কতাঃ জিরা’র গুড়ার কার্যকারিতা বহুল ব্যবহৃত ডায়াবেটিসের ঔষধ Glibenclamide এর সমতুল্য হওয়ায় রক্তে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।কাজেই এ বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসায় ক্যাসিয়া বা দারুচিনিঃ
গবেষণায় দেখা গেছে ইনসুলিনের উপর নির্ভরশীল নয় এমন ডায়াবেটিক রোগীরা নিয়মিত ক্যাসিয়া (আমাদের দেশে যেটা দারুচিনি নামে পাওয়া যায়) খেলে মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে অভুক্ত অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা(FBS) ১৮-২৯% কমে যায়; ট্রাইগ্লিসারাইড কমে ২৩-৩০%; লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন(LDL) কমে ৭-২৭% এবং কোলেষ্টেরলের মাত্রা কমে ১২-২৬%।
মূল উপাদানঃ MHCP ও সিনামিক এসিড।
কীভাবে কাজ করেঃ MHCP ইনসুলিনের ন্যায় কাজ করে।আর সিনামিক এসিড PPAR-gamma কে সক্রিয় করে।এর ফলে একদিকে কোষের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমে যাওয়ায় কোষে সহজেই গ্লুকোজ প্রবেশ করতে পারে আর অন্যদিকে কোষের মধ্যে চর্বিকে প্রবেশ করিয়ে রক্তে এর মাত্রা কমিয়ে দেয়।
নিয়মঃ প্রতিদিন ৩-৬ গ্রাম ক্যাসিয়া সকাল ,দুপুর ও রাতে সমানভাগে ভাগ করে খেতে হবে।এটা আপনি সরাসরি পাউডার আকারে বা স্টিক চিবিয়ে বা এটা দিয়ে চা বানিয়ে খেতে পারেন।
সাবধানতাঃ মাত্রাতিরিক্ত বা অন্যন্য ডায়াবেটিসের ঔষধের সাথে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অতিরিক্ত কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।তাছাড়া ক্যাসিয়াতে কুমারিনের(কুমারিন রক্ত জমাট বাঁধতে বাঁধা দেয়) মাত্রা বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত সেবনে আঘাতপ্রাপ্তস্থানে রক্ত জমাট বাঁধা বাঁধাগ্রস্থ হয়।তাছাড়া যাদের রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা আছে তাদের রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে।কাজেই এসব বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
স্যালাসিয়া বা সপ্তরঙ্গী ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করতে পারেনঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও ইউনিভার্সিটির পুষ্টিবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক Prof.Steve Hertzler এর মতে প্রতিদিন সকালের নাস্তার সাথে ১গ্রাম স্যালাসিয়া বা সপ্তরঙ্গীর নির্যাস (Salacia extract) খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে প্রায় ২৩% এবং দেহে ইনসুলিনের চাহিদা কমে ২৯%।স্যালাসিয়ার কাজ ডায়াবেটিসের ঔষধ Acarbose (যা আমাদের দেশে Gluco-A,Sugatrol,Carbos ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়) এর মত।
মূল উপাদানঃ স্যালিসিনল (SALICINOL) ও কোটাল্যানল (KOTALANOL)- উভয়েই অত্যন্ত শক্তিশালী আলফা-গ্লুকোসাইডেজ এনজাইমের কাজে বাঁধাদানকারী।
কীভাবে কাজ করেঃ শর্করাজাতীয় (ভাত,রুটি,আলু…) খাবার পরিপাককৃত হয়ে অপেক্ষাকৃত সরল শর্করা ওলিগোস্যাকারাইড ও ডাইস্যাকারাইডে পরিণত হয়।অন্ত্রের ভিতরের দেয়ালের কোষের আবরণীতে থাকা আলফা-গ্লুকোসাইডেজ এনজাইম এসব শর্করাকে ভেঙ্গে অতিসরল শর্করা বা মনোস্যাকারাইডে(যেমন-গ্লুকোজ) রূপান্তরিত করে।
স্যালিসিয়ার স্যালিসিনল ও কোটাল্যানল এই এনজাইমের কার্যকারিতাকে বাঁধা দেওয়ায় শর্করাজাতীয় খাবার অতি দ্রুত গ্লুকোজে রূপান্তরিত হতে পারে না।ফলে খাওয়ার পর পর দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়তে পারে না।
মাত্রাঃ প্রতিদিন ১গ্রাম স্যালাসিয়া এক্সট্র্যাক্ট (নির্যাস) সকালে নাস্তার সাথে।এক্সট্র্যাক্ট না পাওয়া গেলে ৩-৬ গ্রাম স্যালাসিয়া গাছ/কাঠের গুড়া বা গুড়া দিয়ে তৈরী চা পান করলেও চলবে।
সাবধানতাঃ স্যালাসিয়া হাইপোগ্লাইসেমিয়া না করলেও অপরিপাককৃত শর্করার কারণে পেট ফাঁপতে পারে,পেট ভার লাগতে পারে,পেট ব্যাথা হতে পারে কিংবা ডায়রিয়া হতে পারে।
ডায়াবেটিস চিরতরে নিরাময় হবে?
যেসব মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের ডায়াবেটিস চিরতরে নিরাময় হবে না। ওষুধ, ব্যায়াম, খাবার-দাবার মেনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন।
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের উপায়ঃ
১. প্রস্রাব পরীক্ষায় প্রস্রাবে গ্লুকোজের উপস্থিতি।
২. রক্ত পরীক্ষায় রক্তের গ্লুকোজ লেভেল বেশি থাকালে।
৩. সকালে খালি পেটে ৭.০ মিলিমোল/লিটার বা এর বেশি হলে।
৪. র্যানডোম ১১.০ মিলিমোল/লিটার বা এর বেশি হলে।
ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল?
আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের গাইডলাইন অনুযায়ী এইচবিএ১সির মান ৫.৭-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাভাবিক ধরা যায়। এটি ৬.৫-এর বেশি হলে ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হবে। এই মান ৫.৭ থেকে ৬.৫-এর মধ্যে থাকলে প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
খালি পেটে ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল?
খালি পেটে রক্তে সুগারের মাত্রা ৫.৫ পয়েন্টের (mmol/l) আশেপাশে থাকা ভালো। যদি ৫.৫ থেকে ৬.৯ পয়েন্টের মধ্যে থাকে, এই অবস্থাকে বলে প্রি-ডায়াবেটিস। যদি ৭ পয়েন্টের উপরে চলে যায়, তাকে ডায়াবেটিস বলে।
খাওয়ার পর ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল?
সাধারণত খাবারের পরে ভরা পেটে দেহের রক্তে সুগার (চিনি উপাদান) এর মাত্রা সামান্য বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিকের কিছু নয়। কিন্তু এই সুগারের মাত্রা যদি ৭.৮ পয়েন্ট ( mmol/l ) ‘এর থেকে বেশি পরিমাণে বেড়ে যায় তাহলে এটাকে প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিকসের পূর্ব লক্ষণ বলা যায়।
আরও পড়ুনঃ উচ্চরক্তচাপ বা হাই প্রেসার এর লক্ষণ ও প্রতিকার
ডায়াবেটিস কত হলে ইনসুলিন নিতে হয়?
রক্তে শর্করা ১৬.৭ মিলিমোল বা ৩০০ গ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি বা গড় শর্করা এইচবিএওয়ান সি ১০ শতাংশের বেশি হলে ইনসুলিন দিয়ে আগে কমিয়ে নিতে হবে। এ অবস্থায় ওষুধ কার্যকর নয়। বরং নানা জটিলতা ডেকে আনবে।
ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?
এক্ষেত্রে সেরকম কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। ডায়াবেটিসের প্রথম ধাপেই আপনাকে বুঝে যতটা সম্ভব খাওয়া-দাওয়া এবং একটি স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-যাপন পালন করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস কী? এই রোগ সম্পর্কে যা জানা খুবই জরুরি