ক্লাউড কম্পিউটিং কী? ক্লাউড কম্পিউটিং সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
ক্লাউড কম্পিউটিংঃ
ক্লাউড অর্থ হচ্ছে মেঘ। আসলে ক্লাউড শব্দটি ইন্টারনেটের রূপক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। আকাশে সর্বত্র যেভাবে মেঘ ছড়িয়ে আছে, ইন্টারনেটও ঠিক তেমনিভাবে সর্বত্র জালের মত ছড়িয়ে আছে। ইন্টারনেটের মেঘ থেকে সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার উপায় বের করতে গিয়েই ক্লাউড কম্পিউটিং এর জন্ম হয়। অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে কম্পিউটারের জগতে ক্লাউড কম্পিউটিং এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে।
ক্লাউড কম্পিউটিং এর মূল বিষয়টি হলো নিজের ব্যবহৃত কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভের পরিবর্তে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী কোন প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে সার্ভিস বা হার্ডওয়্যার ভাড়া নেওয়া। যেমনঃ- কোন প্রতিষ্ঠানের একটি ওয়েব সাইট রয়েছে এবং এই ওয়েব সাইটে একটি ব্লগ চলবে। ব্লগের অধিকাংশ ব্লগার এবং ভিজিটর বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত এই ব্লগে ব্যবহারকারী বেশি থাকে।
এর মধ্যে রাত ৮টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুব বেশি থাকে, ফলে ঐ সময় সার্ভারে খুব চাপ পড়ে, এই লোড কমানোর জন্য ৩/৪টি সার্ভার ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু অন্য সময়ে লোড কম থাকার ফলে ১টি সার্ভারেই কাজ হয়। তাহলে ঐ প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সাইটটি চালানোর জন্য ২৪ ঘন্টাই ৩/৪টি সার্ভার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না, শুধুমাত্র যে সময়ে লোড বেশি থাকে সে সময়ের জন্যই অতিরিক্ত সার্ভারগুলি ভাড়া নিতে পারলেই অনেক খরচ বেঁচে যায়।
এতে করে সার্ভার ভাড়া দেয়া কোম্পানিও ফ্রি সময়ে তাদের সার্ভারগুলি অন্য প্রতিষ্ঠানের নিকট ভাড়া দিতে পারছে। ক্লাউড কম্পিউটিং এর ইতিহাস শুরু হয় ১৯৬০ এর দশকে। ২০০৬ সালে বিশ্ব বিখ্যাত অ্যামাজোন ওয়েব সার্ভিস বাণিজ্যিকভাবে ক্লাউড কম্পিউটিং এর ব্যবহার শুরু করে। ২০১০ সালে The Rackspace Cloud এবং NASA মুক্ত অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস শুরু করে। এভাবেই ক্লাউড কম্পিউটিং জন সাধারণের হাতের মুঠোয় আসে।
১৯৬০ সাল থেকে ক্লাউড কম্পিউটিং এর ইতিহাস শুরু হয়। ২০১০ সালে The Rackspace এবং NASA মুক্ত অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস ব্যবহার শুরু করে। এভাবে জনসাধারণের হাতের মুঠোয় ক্লাউড কম্পিউটিং আসতে শুরু করে। ক্লাউড কম্পিউটিং একটি বিশেষ পরিসেবা। এ উন্নত পরিসেবাটি কিছু কম্পিউটারকে গ্রিড সিস্টেম এর মাধ্যমে সংযুক্ত রাখে। ক্লাউড কম্পিউটিং অনলাইন পরিসেবা, কম্পিউটিং শক্তি, ডাটা অ্যাক্সেস এবং ডাটাস্পেস প্রদান করে যেখানে পরিসেবাগুলো ব্যবহারে ক্লাউড কম্পিউটিং বিষয়ে গভীরভাবে জানার দরকার পড়ে না।
পরিসেবা হিসেবে যে কেউ ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবহার করতে পারেন। বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে বিদ্যুৎ কী করে সংগৃহীত হয় তা জানার যেমন প্রয়োজন হয় না ঠিক তেমনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে বিতরণ সেবা ব্যবহার করে কম্পিউটারে কাজগুলো সম্পাদন করতে ক্লাউড কম্পিউটিং সম্পর্কে বিশদ জানার প্রয়োজন হয় না। ‘Cloud’ এর ধারণা বলতে বুঝায় বিভিন্ন Network সংযোগসমূহ এবং কম্পিউটার ব্যবস্থাসমূহ যা ‘Online’ Services এর অন্তর্ভুক্ত।
ক্লাউড কম্পিউটিং বলতে আমরা এমন এক প্রযুক্তিকে বুঝি যা ডাটা এবং এর প্রয়োগসমূহকে ঠিক বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য Internet এবং এর Central remote Servers (দূরবর্তী সার্ভারসমূহকে) ব্যবহার করে। ক্লাউড কম্পিউটিং ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ভোক্তাদেরকে বা গ্রাহকদেরকে ব্যক্তিগত প্রবেশাধিকারের সুযোগ এনে দেয় যা পৃথিবীর যে প্রান্তের কম্পিউটারেই হোক না কেন।
ক্লাউড কম্পিউটিং কম্পিউটার ব্যবহারের কতকগুলো সমন্বিত উপাদানের সম্মিলিত প্রয়াস যা কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজ করে। ক্লাউড কম্পিউটিং এর প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে Yahoo mail, Gmail অথবা, Hotmail তবে এ জন্য শুধুমাত্র ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন যা থাকলে আমরা মেইল পাঠাতে পারি।
যুক্তরাষ্ট্রের “ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্যন্ডার্ড এন্ড টেস্টিং (NIST)” এর মতে ক্লাউড কম্পিউটিং হলো ক্রেতার তথ্য ও বিভিন্ন এ্যাপ্লিকেশনকে কোন সেবাদাতার সিস্টেমে আউটসোর্স করার এমন একটি মডেল যাতে নিম্নোক্ত ৩টি বৈশিষ্ট্য থাকবেঃ-
১। রিসোর্স স্কেলেবিলিটিঃ ছোট বা বড় হোক, ক্রেতার সব ধরনের চাহিদাই টানো হবে, ক্রেতা যত চাইবে সেবা দাতা ততোই অধিক পরিমাণে সেবা দিতে পারবে।
২। অন-ডিমান্ডঃ ক্রেতা যখন চাইবে, তখনই সেবা দিতে পারবে। ক্রেতা তার ইচ্ছা অনুযায়ী যখন খুশি তার চাহিদা বাড়াতে বা কমাতে পারবে।
৩। পে-অ্যাজ-ইউ-গোঃ এটা একটি পেমেন্ট মডেল। ক্রেতাকে আগে থেকে কোন সার্ভিস রিজার্ভ করতে হবে না। ক্রেতা যা ব্যবহার করবে কেবলমাত্র তার জন্যই পেমেন্ট দিতে হবে। এক কথায় বলা যায়, কম্পিউটার ও ডাটা স্টোরেজ সহজে, ক্রেতার সুবিধামত চাহিবামাত্র এবং ব্যবহার অনুযায়ী ভাড়া দেওয়ার সিস্টেমই হলো ক্লাউড কম্পিউটিং।
আরও পড়ুনঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ১০ টি ব্যবহার
ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের প্রধান সার্ভিস মডেলঃ
সেবার ধরণ অনুসারে ক্লাউড কম্পিউটিংকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-
১। অবকাঠামোগত সেবা (Infrastructure as a services-laaS): ব্যবহারকারী তার প্রয়োজনীয় অপারেটিং সিস্টেম ও সফ্টওয়্যার চালানোর জন্য ক্লাউড সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের নেটওয়ার্ক, সিপিইউ, স্টোরেজ ও অন্যান্য মৌলিক কম্পিউটিং রিসোর্স ভাড়া দেয়।
২। প্ল্যাটফর্মভিত্তিক সেবা (Platform as a services-PaaS): ক্লাউড সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার, অপারেটিং সিস্টেম, ওয়েব সার্ভার, ডেটাবেজ, প্রোগ্রাম এক্সিউশন পরিবেশ ইত্যাদি থাকে। এ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপারগণ তাদের তৈরি করা সফ্টওয়্যার এই প্ল্যাটফর্মে ভাড়ায় চালাতে পারেন।
৩। সফ্টওয়্যার সেবা (Software/application as a services-SaaS): ক্লাউড সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরিকৃত এ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যার ব্যবহারকারীগণ ইন্টারনেটের মাধ্যমে চালাতে পারেন।
সারসংক্ষেপঃ ইন্টারনেট নির্ভর কম্পিউটিং হচ্ছে ক্লাউড কম্পিউটিং। এটা এমন একটি প্রযুক্তি যা অধিকতর সহজভাবে স্বল্প সময়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন অন-লাইন কম্পিউটিং সেবা প্রদান করে থাকে। এই ব্যবস্থায় গ্রাহক বা ব্যবহারকারী সুবিধামত ও চাহিদা অনুযায়ী কম্পিউটার সার্ভার, স্টোরেজ, সফ্টওয়্যার, ভার্চুয়াল মেশিন, ফায়ারওয়্যার ইত্যাদি ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করে।
ক্লাউড কম্পিউটিং এর প্রকারভেদঃ
১. অবস্থানগত দৃষ্টিকোণ থেকে (Location of the cloud computing)
২. সেবা প্রদানের ভিত্তিতে (Type of services offered)
২. অবস্থানগত দৃষ্টিকোণ থেকে ক্লাউড কম্পিউটিংকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথাঃ-
১. পাবলিক ক্লাউড (Public Cloud): পাবলিক ক্লাউড ব্যবস্থায় Computing অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন Cloud vendor ভোক্তাগণের / গ্রাহকগণের এ ব্যাপারে কোনো সংশ্লিষ্টতা বা নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব নেই।
২. প্রাইভেট ক্লাউড (Private Cloud): এ ব্যবস্থায় Computing Infrastructure এর দায়িত্ব একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের কাছে ন্যস্ত থাকে। অন্যান্য সংগঠনের সাথে তা ভাগাভাগি করা হয় না।
৩. হাইব্রিড ক্লাউড (Hybrid Cloud): যদি প্রাইভেট এবং পাবলিক ক্লাউড এক সাথে মিশ্রণ ঘটানো হয় তাকে হাইব্রিড বলে। এ ব্যবস্থাকে অন্যভাবে Cloud Burstingও বলা হয়ে থাকে।
৪. কমিউনিটি ক্লাউড (Community Cloud): কমিউনিটি ক্লাউড বলতে আমরা বুঝি, একই ধাঁচের সংগঠনগুলোর মধ্যে Computing অবকাঠামোর ভাগাভাগিকে সেবা প্রদানের ভিত্তিতে বিভাজন।
আরও পড়ুনঃ ইন্টারনেট কি? ইন্টারনেট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
ক্লাউড কম্পিউটিং এর সুবিধাঃ
১. পরিমিতকরণ অর্জনঃ স্বল্প কর্মশক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে প্রকল্প ও পণ্য একক প্রতি উৎপাদন খরচ হ্রাস করে।
২. প্রযুক্তির পরিকাঠামো ব্যয় হ্রাসঃ সর্বনিম্ন খরচ সাপেক্ষে তথ্য সহজে প্রবেশাধিকার বজায় রাখে।সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক বা বাৎসরিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে পরিশোধের সুযোগ রাখে।
৩. সস্তায় কর্মশক্তিতে বিশ্বায়িত করাঃ ইন্টারনেট সুবিধা থাকা সাপেক্ষে বিশ্বের যে কেউ Cloud এ প্রবেশ বা ব্যবহার করতে পারবে।
৪. কার্যকর ব্যয় সংকোচন প্রক্রিয়াঃ সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ততম সময়ে কম জনবল ব্যয়ে অধিক কর্ম সম্পাদন করে।
৫. মূলধন বিনিয়োগ হ্রাসঃ হার্ডওয়্যার, সফট্ওয়্যার বা লাইসেন্স খরচ মেটানোর জন্য অধিক অর্থ ব্যয় অপ্রয়োজনীয়।
৬. সহজ প্রবেশ্যতা নিশ্চিতকরণঃ যেকোনো স্থান থেকে যখন খুশি এতে প্রবেশ সুবিধা জীবনকে আরও সহজ করে।
৭. অধিক কার্যকর প্রকল্প নিরীক্ষণঃ সমাপ্তির সময় চক্রের আগেই কার্য সম্পাদন করায় বাজেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা যায়।
৮. কর্মী প্রশিক্ষণ ব্যয় অনধিকঃ হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার বিষয়ে অনধিক জ্ঞান সম্পর্কে স্বল্পসংখ্যক কর্মশক্তি ব্যবহার করেও বেশি কাজ করা সম্ভব।
৯. নতুন সফটওয়্যার লাইসেন্সঃ ব্যয়বহুল সফট্ওয়্যার লাইসেন্স বা প্রোগ্রাম ক্রয় ছাড়াই এর বিস্তার ঘটানো যায়।
১০. নমনীয়তাঃ গুরুত্বপূর্ণ কর্মশক্তিকে বা অর্থ সম্পদকে বিপদাপন্ন না করেই গতিধারা পাল্টে ফেলা যায়।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার এর ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
ক্লাউড কম্পিউটিং এর ব্যবহারঃ
ক্লাউড কম্পিউটিং আজকের দিনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুগল এর বিভিন্ন প্রয়োগ- যেমন জিমেইল, পিকাসা থেকে শুরু করে পৃথিবীর আবহাওয়া বা কোনো দেশের আদমশুমারির মতো বিশাল তথ্য ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে এর অপরিসীম ব্যবহার। সর্বোপরি যোগাযোগ ক্ষেত্রে এটি চিকিৎসা ও মানবকল্যাণেও এটি এক অন্যন্য সঙ্গী। এক কথায় ক্লাউড কম্পিউটিং এনেছে অনন্য বিপ্লব।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার কি? কত প্রকার ও কি কি? কম্পিউটার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা