ইস্পাত কি? ইস্পাত কত প্রকার ও কি কি? ইস্পাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ইস্পাত কি?

ইস্পাত হলো লোহা এবং কার্বনের একটি সংকর ধাতু। ইস্পাতে সাধারণত ০.২% থেকে ২.১% কার্বন থাকে।

ইস্পাত কি? ইস্পাত কত প্রকার ও কি কি? ইস্পাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ইস্পাতের শক্তি এবং কঠোরতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এর নমনীয়তা এবং টানা বা তন্যতা হ্রাস পায়।

ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য:

  • শক্তি: ইস্পাত খুব শক্ত এবং অন্যান্য ধাতুর তুলনায় বেশি ঘাত সহ্য করতে পারে।
  • কঠোরতা: ইস্পাত খুব কঠিন এবং সহজে গলিয়ে বা ভেঙে যায় না।
  • নমনীয়তা: ইস্পাত কিছুটা নমনীয়, যার ফলে এটিকে বিভিন্ন আকারে গড়ে তোলা যায়।
  • তন্যতা: ইস্পাত কিছুটা টানা যায়।
  • স্থায়িত্ব: ইস্পাত টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী
  • পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা: ইস্পাত পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

ইস্পাতের ইতিহাস:

ইস্পাতের ব্যবহার প্রায় 4,000 বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা ইস্পাত ব্যবহার করে তলোয়ার, ছুরি এবং অন্যান্য অস্ত্র তৈরি করত। 19 শতকে শিল্প বিপ্লবের সময় ইস্পাত উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।

ইস্পাত কত প্রকার ও কি কি?

ইস্পাত বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। কয়েকটি প্রধান শ্রেণীবিভাগ এবং তাদের উদাহরণ নীচে দেওয়া হলো:

রাসায়নিক গঠনের ভিত্তিতে:

  • কার্বন ইস্পাত: সবচেয়ে সাধারণ ধরণের ইস্পাত। এতে কার্বনই প্রধান মিশ্রণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

  • মিশ্র ইস্পাত: কার্বন ইস্পাতের সাথে অন্যান্য ধাতু যোগ করে তৈরি করা হয়। যেমন: ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, মলিবডেনাম, ইত্যাদি।
  • স্টেইনলেস স্টিল: মরীচিকা বা জারা প্রতিরোধী ইস্পাত। এতে ক্রোমিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে।

উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে:

  • ঢালাই ইস্পাত: ঢালাই করে তৈরি ইস্পাত।
  • রোলড ইস্পাত: রোলিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তৈরি ইস্পাত।

ব্যবহারের ভিত্তিতে:

  • কাঠামোগত ইস্পাত: ভবন, সেতু, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণে ব্যবহৃত ইস্পাত।
  • টুল ইস্পাত: হাতিয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত ইস্পাত।
  • রেল ইস্পাত: রেলপথ নির্মাণে ব্যবহৃত ইস্পাত।

কিছু উল্লেখযোগ্য ইস্পাতের ধরণ:

  • মাইল্ড স্টিল: কার্বন ইস্পাতের একটি সাধারণ ধরণ। 
  • হাই-কার্বন স্টিল: কার্বন ইস্পাতের একটি ধরণ যাতে কার্বনের পরিমাণ বেশি থাকে। এটি খুব শক্ত এবং কঠিন, কিন্তু নমনীয়তা কম।
  • স্টেইনলেস স্টিল: মরীচিকা বা জারা প্রতিরোধী ইস্পাত। 
  • অ্যালয় স্টিল: কার্বন ইস্পাতের সাথে অন্যান্য ধাতু যোগ করে তৈরি করা হয়। 
  • টুল স্টিল: হাতিয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত ইস্পাত।

দ্রষ্টব্য: এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়, আরও অনেক ধরণের ইস্পাত রয়েছে।

ইস্পাত কি দিয়ে তৈরি?

ইস্পাত মূলত দুটি উপাদান দিয়ে তৈরি:

১. লোহা: ইস্পাতের প্রধান উপাদান হলো লোহা। এটি একটি রাসায়নিক মৌল যার প্রতীক Fe এবং পারমাণবিক সংখ্যা 26। লোহা খনিজ আকারে প্রকৃতিতে পাওয়া যায়।

২. কার্বন: ইস্পাতকে লোহার থেকে আলাদা করে তোলে এমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কার্বন। ইস্পাতে সাধারণত 0.2% থেকে 2.1% কার্বন থাকে। কার্বনের পরিমাণ ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।

অন্যান্য উপাদান: উপরে উল্লিখিত দুটি উপাদান ছাড়াও, ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য উন্নত করতে বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • ম্যাঙ্গানিজ: ইস্পাতকে শক্ত এবং টেকসই করে তোলে।
  • ক্রোমিয়াম: ইস্পাতকে মরীচিকা বা জারা প্রতিরোধী করে তোলে।
  • ভ্যানাডিয়াম: ইস্পাতকে শক্ত এবং নমনীয় করে তোলে।
  • নিকেল: ইস্পাতকে শক্ত এবং স্থিতিস্থাপক করে তোলে।
  • মলিবডেনাম: ইস্পাতকে উচ্চ তাপমাত্রায় শক্ত করে তোলে।

ইস্পাত কি কাজে লাগে?

ইস্পাতের ব্যবহার অনেক। ইস্পাত অনেক কাজে লাগে। এর কিছু উদাহরণ নীচে দেওয়া হলো:

  • নির্মাণ: ভবন, সেতু, রাস্তাঘাট, বন্দর, রেলপথ, ইত্যাদি নির্মাণে ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। ইস্পাতের তৈরি বিম, রড, বার, পাত, ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • যানবাহন: গাড়ি, ট্রেন, জাহাজ, বিমান, ইত্যাদি তৈরিতে ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। ইস্পাতের তৈরি ইঞ্জিন, চাকা, অ্যাক্সেল, ফ্রেম, ইত্যাদি যানবাহনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
  • যন্ত্রপাতি: বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি তৈরিতে ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। ইস্পাতের তৈরি মেশিন, টুল, ইলেকট্রিক মোটর, ইত্যাদি যন্ত্রপাতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
  • অস্ত্র: বন্দুক, কামান, ছুরি, ইত্যাদি তৈরিতে ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। ইস্পাতের তৈরি অস্ত্র শক্ত এবং টেকসই হয়।
  • ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ: ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের কিছু অংশে ইস্পাত ব্যবহার করা হয়।
  • অন্যান্য: ইস্পাতের তৈরি রান্নার সরঞ্জাম, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, ইত্যাদি। ইস্পাতের তৈরি পাত, তার, পাইপ, ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।

ইস্পাত ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধাঃ

ইস্পাতের ব্যবহারের সুবিধা:

  • ইস্পাত শক্ত এবং টেকসই।
  • ইস্পাত নমনীয় এবং বিভিন্ন আকারে গড়ে তোলা যায়।
  • ইস্পাত তুলনামূলকভাবে দামে সস্তা।

ইস্পাতের ব্যবহারের অসুবিধা:

  • ইস্পাতে মরীচিকা বা জারা ধরতে পারে।
  • ইস্পাত ভারী হয় ইত্যাদি।

ইস্পাতের দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ

ইস্পাতের দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ (α) হলো ইস্পাতের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির হার, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতিক। 

সূত্র:

ΔL = α * L * ΔT

যেখানে,

ΔL = দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি

α = দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ

L = আদি দৈর্ঘ্য

ΔT = তাপমাত্রা বৃদ্ধি

ইস্পাতের দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগের মান:

  • কার্বন ইস্পাত: 11 × 10^-6 /°C
  • মিশ্র ইস্পাত: 10 × 10^-6 /°C থেকে 13 × 10^-6 /°C
  • স্টেইনলেস স্টিল: 10 × 10^-6 /°C থেকে 12 × 10^-6 /°C

উদাহরণ: 20°C তাপমাত্রায় 1 মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কার্বন ইস্পাতের দণ্ডকে 100°C তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হলে দণ্ডটির দৈর্ঘ্য কতটুকু বৃদ্ধি পাবে?

সমাধান:

ΔT = 100°C - 20°C = 80°C

α = 11 × 10^-6 /°C

L = 1 m

ΔL = 11 × 10^-6 /°C * 1 m * 80°C = 8.8 × 10^-4 m

উত্তর: দণ্ডটির দৈর্ঘ্য 8.8 × 10^-4 m বৃদ্ধি পাবে।

দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগের ব্যবহার:

  • তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে বস্তুর দৈর্ঘ্য পরিবর্তনের পরিমাণ বের করতে।
  • তাপীয় প্রসারণের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে।
  • তাপমাত্রা পরিমাপের যন্ত্র তৈরিতে।

দ্রষ্টব্য:

  • ইস্পাতের ধরণের উপর নির্ভর করে দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগের মান কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।

  • এই সূত্রটি কেবলমাত্র অল্প তাপমাত্রা পরিবর্তনের জন্য প্রযোজ্য।

ইস্পাতের পয়সনের অনুপাত কত?

ইস্পাতের পয়সনের অনুপাত (Poisson's ratio) প্রায় 0.3 । 

পয়সনের অনুপাত হলো একটি উপাদানের অনুপ্রস্থ (lateral) বিকৃতি এবং দৈর্ঘ্য (longitudinal) বিকৃতির অনুপাত। যখন একটি উপাদানকে টানা হয়, তখন এটি দৈর্ঘ্য বরাবর বৃদ্ধি পায় এবং প্রস্থ বরাবর সংকুচিত হয়। পয়সনের অনুপাত এই দুটি বিকৃতির মধ্যে সম্পর্ক নির্দেশ করে।

উদাহরণ: ধরা যাক, একটি ইস্পাতের দণ্ডকে 1% দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করা হয়। এই ক্ষেত্রে, দণ্ডটির প্রস্থ 0.3% হ্রাস পাবে।

ইস্পাতের পয়সনের অনুপাতের মান বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে:

  • ইস্পাতের ধরণ: কার্বন ইস্পাতের পয়সনের অনুপাত স্টেইনলেস স্টিলের তুলনায় বেশি।
  • তাপমাত্রা: তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে পয়সনের অনুপাতও বৃদ্ধি পায়।
  • প্রক্রিয়াজাতকরণ: ইস্পাতের প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি পয়সনের অনুপাতকে প্রভাবিত করতে পারে।

পয়সনের অনুপাতের ব্যবহার:

  • উপাদানের স্থিতিস্থাপকতা (elasticity) নির্ণয় করতে।
  • উপাদানের ভেঙে যাওয়ার (fracture) সম্ভাবনা বের করতে।
  • কাঠামোগত নকশায় (structural design)।

দ্রষ্টব্য:

  • পয়সনের অনুপাত একটি নির্দিষ্ট মান নয়, এটি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
  • এই অনুপাত কেবলমাত্র স্থিতিস্থাপক সীমার (elastic limit) মধ্যে প্রযোজ্য।

ইস্পাতের ইয়ং গুণাঙ্ক কত?

ইস্পাতের ইয়ং গুণাঙ্ক 200 × 10^9 Pa থেকে 210 × 10^9 Pa পর্যন্ত হতে পারে।

ইয়ং গুণাঙ্ক হলো একটি উপাদানের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির হারের সাথে প্রযুক্ত বলের অনুপাত। বিভিন্ন ধরণের ইস্পাতের ইয়ং গুণাঙ্কের মান ভিন্ন হতে পারে।

কিছু উদাহরণ:

  • কার্বন ইস্পাত: 200 × 10^9 Pa
  • মিশ্র ইস্পাত: 200 × 10^9 Pa থেকে 210 × 10^9 Pa
  • স্টেইনলেস স্টিল: 190 × 10^9 Pa থেকে 200 × 10^9 Pa

ইয়ং গুণাঙ্কের ব্যবহার:

  • উপাদানের স্থিতিস্থাপকতা (elasticity) নির্ণয় করতে।
  • উপাদানের ভেঙে যাওয়ার (fracture) সম্ভাবনা বের করতে।
  • কাঠামোগত নকশায় (structural design)।

দ্রষ্টব্য:

  • ইয়ং গুণাঙ্ক একটি নির্দিষ্ট মান নয়, এটি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
  • এই অনুপাত কেবলমাত্র স্থিতিস্থাপক সীমার (elastic limit) মধ্যে প্রযোজ্য।

রাবার ও ইস্পাতের মধ্যে কোনটি বেশি স্থিতিস্থাপক ও কেন?

ইস্পাত রাবার অপেক্ষা বেশি স্থিতিস্থাপক কারণ:

  1. আণবিক বন্ধন: ইস্পাতে ধাতব বন্ধন থাকে, যা রাবারের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। ধাতব বন্ধনে, ইলেকট্রনগুলি মুক্তভাবে ধাতু পরমাণুগুলির মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হয়, যার ফলে একটি শক্তিশালী ত্রি-মাত্রিক জালি তৈরি হয়। রাবারে, কোভালেন্ট বন্ধন থাকে, যা ধাতব বন্ধনের তুলনায় দুর্বল।
  2. কাঠামোগত পার্থক্য: ইস্পাতের স্ফটিক কাঠামো রয়েছে, যার অর্থ এর পরমাণুগুলি একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে সাজানো থাকে। এই প্যাটার্ন ইস্পাতকে শক্ত এবং স্থিতিস্থাপক করে তোলে। রাবারের অ্যামোরফাস কাঠামো রয়েছে, যার অর্থ এর পরমাণুগুলি কোন নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে না। এই অ্যামোরফাস কাঠামো রাবারকে নমনীয় করে তোলে, তবে এটি কম স্থিতিস্থাপক করে তোলে।
  3. তাপীয় প্রসারণ: ইস্পাতের তাপীয় প্রসারণের হার রাবারের তুলনায় কম। এর মানে হল যে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে ইস্পাত তার আকার কম পরিবর্তন করে। রাবার তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক বেশি প্রসারিত হয়, যা এটিকে কম স্থিতিস্থাপক করে তোলে।

উদাহরণ:

যদি আপনি একটি ইস্পাতের বার এবং একটি রাবার ব্যান্ড টানেন, তাহলে ইস্পাতের বার রাবার ব্যান্ডের তুলনায় অনেক বেশি বল প্রয়োগ করবে।

ইস্পাতের আপেক্ষিক তাপ কত?

ইস্পাতের আপেক্ষিক তাপ 450 J/(kg °K) থেকে 500 J/(kg °K) পর্যন্ত হতে পারে। আপেক্ষিক তাপ হলো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ দিয়ে কোনো পদার্থের তাপমাত্রা 1°C বৃদ্ধি করতে কতটুকু তাপের প্রয়োজন।

বিভিন্ন ধরণের ইস্পাতের আপেক্ষিক তাপের মান ভিন্ন হতে পারে।

কিছু উদাহরণ:

  • কার্বন ইস্পাত: 450 J/(kg °K)
  • মিশ্র ইস্পাত: 460 J/(kg °K) থেকে 480 J/(kg⋅K)
  • স্টেইনলেস স্টিল: 480 J/(kg °K) থেকে 500 J/(kg °K)

আপেক্ষিক তাপের ব্যবহার:

  • তাপীয় প্রকৌশলে (thermal engineering)।
  • তাপীয় নকশায় (thermal design)।
  • তাপীয় বিশ্লেষণে (thermal analysis)।

দ্রষ্টব্য:

  • আপেক্ষিক তাপ একটি নির্দিষ্ট মান নয়, এটি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
  • এই মান কেবলমাত্র নির্দিষ্ট তাপমাত্রা এবং চাপের জন্য প্রযোজ্য।

ইস্পাত কোন ভাষার শব্দ?

ইস্পাত" শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফার্সি ভাষায় "ইস্পাত" শব্দের অর্থ "শক্ত" বা "কঠিন"। বাংলা ভাষায় "ইস্পাত" শব্দটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইংরেজি ভাষায় "ইস্পাত" শব্দটি "steel" হিসেবে পরিচিত।

উল্লেখ্য:

  • "ইস্পাত" শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কিছু লোক মনে করেন যে "ইস্পাত" শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। অন্যরা মনে করেন যে এটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে।

লোহা ও ইস্পাতের মধ্যে পার্থক্য

লোহা ও ইস্পাতের মধ্যে পার্থক্য:

উপাদান:

  • লোহা: লোহা একটি রাসায়নিক মৌল যার প্রতীক Fe এবং পারমাণবিক সংখ্যা 26। এটি একটি ধাতু যা প্রকৃতিতে খনিজ হিসেবে পাওয়া যায়।
  • ইস্পাত: ইস্পাত লোহার একটি সংকর ধাতু যাতে কার্বন থাকে। কার্বনের পরিমাণ ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।

কার্বনের পরিমাণ:

  • লোহা: লোহায় সাধারণত 0.02% - 2% কার্বন থাকে।
  • ইস্পাত: ইস্পাতে 0.2% - 2.1% কার্বন থাকে।

বৈশিষ্ট্য:

  • লোহা: লোহা নরম, নমনীয় এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল।
  • ইস্পাত: ইস্পাত লোহার তুলনায় শক্ত এবং টেকসই।

ব্যবহার:

  • লোহা: লোহা বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ সামগ্রী, যন্ত্রপাতি, এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে ব্যবহার করা হয়।
  • ইস্পাত: ইস্পাত ভবন, সেতু, রাস্তাঘাট, যানবাহন, এবং যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

মূল্য:

  • লোহা: লোহার দাম ইস্পাতের তুলনায় কম।
  • ইস্পাত: ইস্পাতের দাম লোহার তুলনায় বেশি।

কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য:

বৈশিষ্ট্য লোহা ইস্পাত
কার্বনের পরিমাণ 0.02% - 2% 0.2% - 2.1%
শক্ততা নরম শক্ত
নমনীয়তা নমনীয় তুলনামূলকভাবে কম নমনীয়
স্থায়িত্ব দীর্ঘস্থায়ী খুব দীর্ঘস্থায়ী
ব্যবহার নির্মাণ সামগ্রী, যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ ইত্যাদি ভবন, সেতু, রাস্তাঘাট, যানবাহন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি
মূল্য কম বেশি


উল্লেখ্য:

  • লোহা ও ইস্পাতের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা কঠিন কারণ বিভিন্ন ধরণের লোহা ও ইস্পাত রয়েছে।
  • কিছু ক্ষেত্রে, লোহা ও ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য একই রকম হতে পারে।

ইস্পাত কিভাবে তৈরি করা হয়?

ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া দুটি প্রধান ধাপে বিভক্ত:

১. লোহা তৈরি: 

  • খনিজ থেকে লোহা আকরিক বের করা: লোহা আকরিক খনন করে বের করা হয় এবং তারপর প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ভেঙে ফেলা হয়।
  • ব্লাস্ট ফার্নেসে লোহা তৈরি: লোহা আকরিক, কোক এবং চুনাপাথর ব্লাস্ট ফার্নেসে উত্তপ্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়া লোহা আকরিক থেকে অক্সিজেন অপসারণ করে এবং তরল লোহা তৈরি করে।
  • লোহা ঢালাই: তরল লোহা ঢালাই করে "পিগ লোহা" তৈরি করা হয়।

২. ইস্পাত তৈরি:

  • বেসিক অক্সিজেন ফার্নেস (BOF) প্রক্রিয়া: পিগ লোহা, স্ক্র্যাপ ইস্পাত এবং অক্সিজেন BOF চুল্লিতে উত্তপ্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়া অপরিশোধিত ইস্পাত থেকে অক্সিজেন এবং অন্যান্য উপাদান অপসারণ করা হয়।
  • ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (EAF) প্রক্রিয়া: স্ক্র্যাপ ইস্পাত এবং অন্যান্য উপাদান EAF চুল্লিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গলানো হয়। এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধরণের ইস্পাত তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।
  • ঢালাই এবং রোলিং: তরল ইস্পাত ঢালাই করে বিভিন্ন আকারের ইস্পাত তৈরি করা হয়। ইস্পাতের ব্লক গরম করে রোলিং করে পাত, বার, রড ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

  • কার্বনের পরিমাণ: ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে কার্বনের পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • অন্যান্য উপাদান: ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য উন্নত করতে ব্যবহার করা হয়।
  • তাপমাত্রা: ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
  • মান নিয়ন্ত্রণ: ইস্পাতের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।

ইস্পাত কে শক্ত করতে কোনটির প্রভাব সবচেয়ে বেশি?

ইস্পাতকে শক্ত করতে কার্বন এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ইস্পাতে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে এর শক্তি, টানশক্তি এবং কঠোরতা বৃদ্ধি পায়।

কিছু অন্যান্য উপাদান যা ইস্পাতকে শক্ত করতে পারে:

  • ম্যাঙ্গানিজ: ইস্পাতকে শক্ত এবং টেকসই করে তোলে।
  • ক্রোমিয়াম: ইস্পাতকে জারা প্রতিরোধী করে তোলে।
  • ভ্যানাডিয়াম: ইস্পাতকে শক্ত এবং নমনীয় করে তোলে।
  • নিকেল: ইস্পাতকে শক্ত এবং স্থিতিস্থাপক করে তোলে।
  • মলিবডেনাম: ইস্পাতকে উচ্চ তাপমাত্রায় শক্ত করে তোলে।

ইস্পাতকে শক্ত করার প্রক্রিয়া:

  • তাপ প্রক্রিয়াজাতকরণ বা হিট ট্রিটমেন্ট: ইস্পাতকে উত্তপ্ত করে এবং তারপর ধীরে ধীরে শীতল করে এর শক্তি এবং কঠোরতা বৃদ্ধি করা হয়।
  • কোল্ড ওয়ারকিং: ইস্পাতকে ঠান্ডা অবস্থায় কোল্ড ওয়ারকিং করে এর শক্তি এবং টানশক্তি বৃদ্ধি করা হয়।

উল্লেখ্য:

  • ইস্পাতের শক্তি তার রাসায়নিক গঠন, তাপ প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কোল্ড ওয়ারকিং এর উপর নির্ভর করে।
  • ইস্পাতের শক্তি বৃদ্ধি করলে তার নমনীয়তা এবং ঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।

ইস্পাতে কার্বনের পরিমাণ কত?

ইস্পাতে কার্বনের পরিমাণ ০.১৫% থেকে ২.১% পর্যন্ত হতে পারে।

কার্বনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে ইস্পাতকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

  • মৃদু ইস্পাত: ০.১৫% থেকে ০.২৫% কার্বন
  • মাঝারি ইস্পাত: ০.২৫% থেকে ০.৬% কার্বন
  • শক্ত ইস্পাত: ০.৬% থেকে ২.১% কার্বন

ইস্পাতে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে  কি হয়?

ইস্পাতে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে এর বৈশিষ্ট্যের কিছু পরিবর্তন ঘটে যেমন:

  • শক্তি বৃদ্ধি পায়।
  • কঠোরতা বৃদ্ধি পায়।
  • নমনীয়তা হ্রাস পায়।
  • টান বল হ্রাস পাই।
  • ঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় ইত্যাদি।

বিভিন্ন ধরণের ইস্পাত এবং তাদের ব্যবহার:

  • মৃদু ইস্পাত: গাড়ি, জাহাজ, ভবন, এবং অন্যান্য কাঠামোগত কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • মাঝারি ইস্পাত: যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, এবং অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
  • শক্ত ইস্পাত: কাটার সরঞ্জাম, স্প্রিং, এবং বল বিয়ারিং তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

উল্লেখ্য:

  • ইস্পাতে কার্বনের পরিমাণ ছাড়াও, অন্যান্য উপাদানও ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।
  • ইস্পাতের রাসায়নিক গঠন, তাপ প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং শীতল কাজের উপর নির্ভর করে ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়।

ইস্পাত কে আবিষ্কার করেন?

ইস্পাতের আবিষ্কারের কৃতিত্ব একক ব্যক্তির নয়, বরং এটি ধাতুবিদ্যা ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে বিবর্তিত প্রযুক্তির ফসল। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ লোহার সাথে কাজ করে আসছে। প্রায় 4000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মিশরীয়রা লোহার তৈরি অস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহার করত।

1200 খ্রিস্টপূর্বাব্দে, অ্যানাটোলিয়ায় (বর্তমান তুরস্ক) লোহার তৈরি ইস্পাত তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেছে। চীনে, 1000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইস্পাত তৈরির উন্নত প্রক্রিয়া বিকশিত হয়েছিল।

মধ্যযুগে, ইউরোপে ইস্পাত তৈরির প্রযুক্তি উন্নত হতে থাকে। 18 শতকে, শিল্প বিপ্লবের সময়, ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া আরও উন্নত হয়েছিল এবং ইস্পাত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়ার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কিছু ব্যক্তি:

  • বেনজামিন হান্টসম্যান: 1740 সালে, তিনি ইস্পাত তৈরির "ক্রুসিবল প্রক্রিয়া" আবিষ্কার করেন।
  • হেনরি বেসেমার: 1856 সালে, তিনি "বেসেমার প্রক্রিয়া" আবিষ্কার করেন, যা ইস্পাত তৈরিকে আরও দ্রুত এবং সহজ ও সস্তা করে তোলে।
  • উইলিয়াম সিমেন্স: 1868 সালে, তিনি "ওপেন হার্থ প্রক্রিয়া" আবিষ্কার করেন, যা উচ্চমানের ইস্পাত তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।

আজকাল, ইস্পাত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাতুগুলির মধ্যে একটি। এটি ভবন, সেতু, গাড়ি, জাহাজ এবং আরও অনেক কিছু তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুনঃ ধাতু কাকে বলে? ধাতু কত প্রকার ও কি কি? ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

লৌহ ও ইস্পাত শিল্প কাকে বলে?

লৌহ আকরিক থেকে লৌহ উত্তোলন এবং লৌহকে ইস্পাতে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত সকল কার্যক্রমকে লৌহ ও ইস্পাত শিল্প বলা হয়।

এই শিল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলি হল:

  • খনন: লৌহ আকরিক খনন করে বের করা।
  • প্রক্রিয়াজাতকরণ: লৌহ আকরিক থেকে লৌহ উত্তোলন করা।
  • শোধন: লৌহকে অপরিশোধিত ইস্পাতে রূপান্তর করা।
  • মিশ্রণ: অপরিশোধিত ইস্পাতে কার্বন এবং অন্যান্য উপাদান যোগ করে ইস্পাত তৈরি করা।
  • ঢালাই: ইস্পাতকে বিভিন্ন আকারে ঢালাই করা।
  • ঘূর্ণায়মান: ইস্পাতকে বিভিন্ন আকারে রোল করা।
  • শেষ প্রক্রিয়াজাতকরণ: ইস্পাতকে প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য প্রদান করা।

লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের গুরুত্ব:

  • লৌহ ও ইস্পাত শিল্প একটি ভারী শিল্প, যা অন্যান্য অনেক শিল্পের ভিত্তি তৈরি করে।
  • নির্মাণ, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, এবং অন্যান্য অনেক শিল্পে লৌহ ও ইস্পাত ব্যবহার করা হয়।
  • লৌহ ও ইস্পাত শিল্প একটি দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের লৌহ ও ইস্পাত শিল্প:

  • বাংলাদেশে লৌহ ও ইস্পাত শিল্প একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প।
  • বাংলাদেশে বেশ কিছু বড় লৌহ ও ইস্পাত কারখানা রয়েছে।
  • বাংলাদেশ সরকার লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

আরও পড়ুনঃ সংকর ধাতু কী? সংকর ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url