তাপ ও তাপমাত্রা কাকে বলে? তাপ ও তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কি? তাপ ও তাপমাত্রা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
তাপ কাকে বলে?
যার প্রভাবে কোন বস্তু ঠাণ্ডা বা গরম অনভূত হয়, তাই তাপ। ভিন্ন তাপমাত্রার দুটি বস্তু পরস্পরের তাপীয় সংস্পর্শে আনলে বস্তুর দুটি তাপীয় সাম্যতায় না আসা পর্যন্ত উঁচ্চ তাপমাত্রার বস্তুটি থেকে নিম্ন তাপমাত্রার বস্তুতে যে শক্তি প্রবাহিত হয় তাকে তাপ বলে।
তাপ এক প্রকার অদৃশ্য শক্তি যা ঠান্ডা বা গরমের অনুভুতি জন্মায়।
আরও পড়ুনঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ১০টি ব্যবহার
তাপের বৈশিষ্ট্য:
তাপ হল শক্তির একটি রূপ যা কোনো বস্তুকে গরম বা ঠান্ডা করে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌতিক ধারণা যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
1. অণুর গতিশীল শক্তি: তাপ একটি বস্তুর অণুগুলির গড় গতিশীল শক্তির পরিমাপ। অণুগুলি যত দ্রুত কম্পন করে, তাপের পরিমাণ তত বেশি হয়।
2. তাপমাত্রার সাথে সম্পর্ক: তাপমাত্রা তাপের তীব্রতা মাপে, কিন্তু তাপ নিজেই শক্তির পরিমাণ। উচ্চ তাপমাত্রা মানে বেশি তাপ, তবে এটি সবসময় সত্য নয় (যেমন, বরফের একটি বড় টুকরোতে একটি ছোট গরম পানির কাপের চেয়ে বেশি তাপ থাকতে পারে)।
3. স্থানান্তরযোগ্যতা: তাপ সর্বদা উচ্চ তাপমাত্রার বস্তু থেকে নিম্ন তাপমাত্রার বস্তুতে প্রবাহিত হয়। এই প্রক্রিয়া তাপীয় সাম্য না আসা পর্যন্ত চলতে থাকে।
4. পরিমাপ একক: তাপের SI একক হল জুল (J)। অন্যান্য একক যেমন ক্যালরি, BTU (British Thermal Unit) ও কিলোওয়াট-ঘণ্টাও ব্যবহৃত হয়।
5. বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন: তাপ প্রয়োগে বা অপসারণে বস্তুর অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে (যেমন, বরফ গলে পানি হওয়া)। এই প্রক্রিয়ায় লীন তাপ ব্যবহৃত বা নির্গত হয়।
6. আপেক্ষিক তাপ: বিভিন্ন পদার্থের তাপ ধারণ ক্ষমতা ভিন্ন হয়। আপেক্ষিক তাপ হল একক ভরের তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে প্রয়োজনীয় তাপের পরিমাণ।
7. তাপ স্থানান্তরের পদ্ধতি:
- পরিবহন: কঠিন পদার্থে।
- সংবহন: তরল ও গ্যাসীয় পদার্থে।
- বিকিরণ: শূন্য মাধ্যমেও সম্ভব।
8. থার্মোডাইনামিক্সের সূত্র:
- প্রথম সূত্র: শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধু রূপান্তর করা যায়।
- দ্বিতীয় সূত্র: তাপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শীতল বস্তু থেকে গরম বস্তুতে প্রবাহিত হয় না।
9. কাজের সাথে সম্পর্ক: তাপ কাজে রূপান্তরিত হতে পারে এবং কাজও তাপে রূপান্তরিত হতে পারে। এই ধারণা হিট ইঞ্জিন ও রেফ্রিজারেটরের কার্যপ্রণালীর ভিত্তি।
10. এন্ট্রপির সাথে সম্পর্ক: তাপ স্থানান্তরের ফলে সিস্টেমের এন্ট্রপি বাড়ে। এন্ট্রপি বৃদ্ধি মানে সিস্টেমের অনিয়ম বৃদ্ধি। তাপের এই ধারণা ও বৈশিষ্ট্যগুলি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রকৌশল এবং দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
11. তাপ বস্তুর আয়তন পরিবর্তন করতে পারে: সাধারণত, কোনো বস্তুকে গরম করলে তার আয়তন বৃদ্ধি পায়।
12. তাপ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে পারে: অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়া তাপের উপস্থিতিতে ঘটে।
তাপের বিভিন্ন একক (Different Units of heat):
(ক) ক্যালরি (Calorie): সি.জি.এস. পদ্ধতিতে তাপের একক ক্যালরি। এক গ্রাম ভর বিশিষ্ট বিশুদ্ধ পানির তাপমাত্রা 1° C (14.5 হতে 15.5 পর্যন্ত) বাড়াতে যে তাপের প্রয়োজন হয় তাকে এক ক্যালরি বলে।
1 ক্যালরি = 1 গ্রাম পানি 1° C তাপমাত্রা।
(খ) কিলোগ্রাম ক্যালোরি (Kilogram Calorie): সি.জি.এস. পদ্ধতিতে তাপের বৃহত্তর একক কিলোগ্রাম ক্যালরি বা কিলোক্যালরি। এক কিলোগ্রাম বিশুদ্ধ পানির তাপমাত্রা 1° C বাড়াতে যে তাপের প্রয়োজন হয় তাকে এক কিলোক্যালরি বলে।
1 কিলোক্যালরি = 1 কেজি পানি 1° C তাপমাত্রা = 1000 ক্যালরি।
(গ) ব্রিটিশ তাপীয় একক (B.T.U): এফ.পি.এস পদ্ধতিতে তাপের একক ব্রিটিশ তাপীয় একক বা সংক্ষেপে বি.টি.ইউ.। এক পাউন্ড বিশুদ্ধ পানির তাপমাত্রা বাড়াতে যে তাপের প্রয়োজন হয় তাকে ব্রিটিশ তাপীয় একক (বি.টি.ইউ.) বলে।
1 বি.টি.ইউ. = 1 পাউন্ড বিশুদ্ধ পানি × 1° F পানির তাপমাত্রা।
(ঘ) থার্ম (Therm): এফ.পি.এস. পদ্ধতির তাপের বৃহত্তর একক থার্ম। 1000 পাউন্ড বিশুদ্ধ পানির তাপমাত্রা 100° F বাড়াতে যে তাপের প্রয়োজন হয়, তাকে এক থার্ম বলে।
1 থার্ম = 1000 পাউন্ড বিশুদ্ধ পানি × 100° F তাপমাত্রা = 10⁵ বি.টি.ইউ.।
(ঙ) সি.এইচ.ইউঃ এক পাউন্ড বিশুদ্ধ পানির তাপমাত্রা 1° সেঃ বৃদ্ধি করতে যে তাপের প্রয়োজন হয়, তাকে সি.এইচ. ইউ. বলে।
(চ) তাপের আন্তর্জাতিক একক (SI Unit of heat): আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে তাপ, শক্তি ও কাজ একই এককে পরিমাপ করা হয়। এই একক হচ্ছে জুল (Joule)।
1 জুল = 1 নিউটন বল (N) × 1 মিটার দূরত্ব (m) আবার,
1 ক্যালরি = 4.1868 বা 4.2 জুল এবং 1 কিলোক্যালরি = 4200 জুল বা 4.2 কিলোজুল।
তাপের প্রভাব:
- একটি গরম চুলা থেকে একটি পাত্রে তাপ স্থানান্তরিত হয়ে পাত্রের পানি গরম হয়। এখানে তাপ চালন পদ্ধতিতে স্থানান্তরিত হয়।
- একটি কেতলির পানি গরম হলে পানির উপরের অংশের উষ্ণ পানি উপরে উঠে যায় এবং নিচের ঠান্ডা পানি উপরে আসে। এখানে তাপ সমবাহন পদ্ধতিতে স্থানান্তরিত হয়।
- সূর্য থেকে পৃথিবীতে তাপ বিকিরণ পদ্ধতিতে আসে।
তাপ সঞ্চালনের পদ্ধতি:
তাপ শক্তি কাকে বলে?
তাপ কিভাবে উৎপন্ন হয়?
তাপমাত্রা কাকে বলে?
তাপমাত্রা হচ্ছে কোনো বস্তুর তাপীয় অবস্থা যা অন্য কোনো বস্তুর তাপীয় সংস্পর্শে আনলে তাপ গ্রহণ করবে, না তাপ বর্জন করবে তা নির্ধারণ করে। সাধারণত তাপমাত্রা সেলসিয়াস, ফারেনহাইট বা কেলভিন স্কেলে মাপা হয়।
আরও পড়ুনঃ বিভিন্ন প্রকার গ্রাইন্ডিং মেশিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
তাপমাত্রার বৈশিষ্ট্য
তাপমাত্রা হলো কোনো বস্তুর গরম বা ঠান্ডা হওয়ার পরিমাপ। এটি একটি ভৌতিক রাশি যা কোনো বস্তুর অণুগুলো কত দ্রুত কাঁপছে তা নির্দেশ করে।
তাপমাত্রার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
1. পরিমাপযোগ্য: তাপমাত্রা একটি পরিমাপযোগ্য রাশি। আমরা থার্মোমিটারের সাহায্যে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা পরিমাপ করতে পারি।
2. সর্বনিম্ন সীমা: তাত্ত্বিকভাবে, তাপমাত্রার একটি সর্বনিম্ন সীমা রয়েছে যাকে পরম শূন্য বলা হয়। এই তাপমাত্রায় কোনো বস্তুর অণুগুলোর গতি সম্পূর্ণ স্থির হয়ে যায়।
3. ভিন্ন এককে প্রকাশযোগ্য: তাপমাত্রা সেলসিয়াস, ফারেনহাইট এবং কেলভিন ইউনিটে প্রকাশ করা হয়।
4. তাপের সাথে সম্পর্ক: তাপমাত্রা এবং তাপ দুটি ভিন্ন ধারণা। তাপ হলো শক্তির একটি রূপ যা একটি বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে স্থানান্তরিত হতে পারে, আর তাপমাত্রা হলো এই শক্তির পরিমাণের একটি পরিমাপ।
5. বস্তুর অবস্থা নির্ধারণ করে: কোনো বস্তুর তাপমাত্রা তার অবস্থা (কঠিন, তরল বা গ্যাস) নির্ধারণ করে। যেমন, পানি শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে বরফে পরিণত হয় এবং ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বাষ্পে পরিণত হয়।
6. বস্তুর আয়তনকে প্রভাবিত করে: সাধারণত, কোনো বস্তুর তাপমাত্রা বাড়লে তার আয়তনও বৃদ্ধি পায়।
7. বস্তুর ঘনত্বকে প্রভাবিত করে: তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেশিরভাগ পদার্থের ঘনত্ব কমে যায়।
তাপমাত্রার প্রভাব:
1. আবহাওয়া: আবহাওয়ার পরিবর্তন তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল।
2. জীবন: সকল জীবের জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা পরিসর প্রয়োজন।
3. শিল্প: বিভিন্ন শিল্প প্রক্রিয়ায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
4. দৈনন্দিন জীবন: আমরা প্রতিদিনই তাপমাত্রার প্রভাব অনুভব করি।
উদাহরণ:
1. একটি গরম চুলা একটি ঠান্ডা বরফের তুলনায় অনেক বেশি গরম। এখানে চুলার তাপমাত্রা বরফের তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
2. গরমকালে পানির পাইপ ফেটে যাওয়ার কারণ হলো তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানির আয়তন বৃদ্ধি পাওয়া।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক কি? কত প্রকার ও কি কি? কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
তাপমাত্রা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তাপমাত্রা পরিমাপের যন্ত্র:
তাপ ও তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য
আমরা প্রায়ই "গরম" বা "ঠান্ডা" শব্দ দুটি ব্যবহার করি। কিন্তু এই গরম বা ঠান্ডা আসলে কী? এই গরম বা ঠান্ডা মাপার জন্য আমরা দুটি ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করি তাপ এবং তাপমাত্রা।
তাপ এবং তাপমাত্রা দুটি ভিন্ন ধারণা। তাপ এবং তাপমাত্রা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হলেও এদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। আসুন দেখি তাদের মধ্যে কী কী পার্থক্য আছে:
তাপ:
সংজ্ঞা: তাপ হলো শক্তির একটি রূপ। যখন কোনো বস্তুকে গরম করা হয়, তখন সেই বস্তুতে তাপ শক্তি যোগ করা হয়। এই তাপ শক্তির কারণেই আমরা বস্তুটিকে গরম বলি।
একক: জুল (Joule) হলো তাপের একক।
পরিমাণ: একটি বস্তুতে কত পরিমাণ তাপ আছে তা পরিমাপ করা যায়।
স্থানান্তর: তাপ একটি বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে স্থানান্তরিত হতে পারে।
তাপমাত্রা:
সংজ্ঞা: তাপমাত্রা হলো কোনো বস্তুর গরম বা ঠান্ডা হওয়ার পরিমাপ। এটি বস্তুর মধ্যে অণুগুলো কতটা দ্রুত কাঁপছে তা নির্দেশ করে।
একক: সেলসিয়াস (℃), ফারেনহাইট (℉), কেলভিন (K) হলো তাপমাত্রার একক।
পরিমাণ: একটি বস্তুর তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায়।
স্থানান্তর: তাপমাত্রা স্থানান্তরিত হয় না, বরং তাপ স্থানান্তরের ফলে তাপমাত্রা পরিবর্তিত হয়।
তাপ এবং তাপমাত্রার পার্থক্য নিচে টেবিল আকারে দেওয়া হলো:
বৈশিষ্ট্য | তাপ | তাপমাত্রা |
---|---|---|
সংজ্ঞা | এটি একটি শক্তির রূপ যা এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে স্থানান্তরিত হয়। | এটি কোনো বস্তুর উষ্ণতা বা ঠাণ্ডার পরিমাপ। |
একক | জুল (J), ক্যালরি (cal), কিলোক্যালরি (kcal)। | সেলসিয়াস (°C), ফারেনহাইট (°F), কেলভিন (K)। |
পরিমাপ | ক্যালরিমিটার দ্বারা পরিমাপ করা হয়। | থার্মোমিটার দ্বারা পরিমাপ করা হয়। |
প্রকৃতি | এটি একটি বস্তুর মোট শক্তির পরিমাণ। | এটি একটি বস্তুর অণুগুলির গড় গতিশীল শক্তি। |
নির্ভরশীলতা | বস্তুর ভর বা পরিমাণের উপর নির্ভর করে। | বস্তুর ভর বা পরিমাণের উপর নির্ভর করে না। |
স্থানান্তরযোগ্যতা | এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে স্থানান্তরিত হতে পারে। | স্থানান্তরিত হয় না, তবে সাম্যতা অর্জন করতে পারে। |
শূন্য মান | পরম শূন্য তাপমাত্রায় শূন্য হয়। | পরম শূন্য (-273.15°C বা 0K) এর নিচে যেতে পারে না। |
তাপ ও তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্যের একটি উদাহরণ:
একটি ছোট পাত্রে গরম পানি এবং একটি বড় পাত্রে ঠান্ডা পানি আছে। ছোট পাত্রের পানির তাপমাত্রা বেশি হলেও, বড় পাত্রের পানির মোট তাপের পরিমাণ বেশি হতে পারে কারণ বড় পাত্রে পানির পরিমাণ বেশি।
তাপ হলো শক্তি এবং তাপমাত্রা হলো সেই শক্তির পরিমাপ। তাপ স্থানান্তরিত হতে পারে, কিন্তু তাপমাত্রা স্থানান্তরিত হয় না।
আরও পড়ুনঃ ধাতু কাকে বলে? ধাতু কত প্রকার ও কি? ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা