ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত জানুন
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার কাকে বলে?
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার হল এমন একটি ইলেকট্রনিক সার্কিট যা এসি (Alternating Current) বিদ্যুৎকে ডিসি (Direct Current) বিদ্যুতে রূপান্তর করে।
এটি হাফ-ওয়েভ রেকটিফায়ারের চেয়ে বেশি দক্ষ এবং এটি AC সিগনালের পূর্ণ তরঙ্গকে (উভয় ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক অর্ধ-সাইকেল) DC তে পরিবর্তন করে।
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার কত প্রকার ও কি কি?
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার মূলত দুই প্রকার:
1. সেন্টার-ট্যাপ ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার: এই ধরনের রেকটিফায়ারে একটি সেন্টার-ট্যাপড ট্রান্সফর্মার এবং দুটি ডায়োড ব্যবহার করা হয়। ট্রান্সফর্মারের সেকেন্ডারি ওয়াইন্ডিংয়ের মাঝখানের পয়েন্টকে সেন্টার ট্যাপ বলা হয়। এসি সিগন্যালের ধনাত্মক অর্ধচক্রে একটি ডায়োড ফরওয়ার্ড বায়াসে থাকে এবং ঋণাত্মক অর্ধচক্রে অন্য ডায়োড ফরওয়ার্ড বায়াসে থাকে। ফলে, লোডে সর্বদা একই ধরনের পোলারিটির কারেন্ট প্রবাহিত হয়।
2. ব্রিজ ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার: এই ধরনের রেকটিফায়ারে চারটি ডায়োড একটি ব্রিজের মতো সংযুক্ত থাকে। এসি সিগন্যালের প্রতিটি অর্ধচক্রে দুটি ডায়োড ফরওয়ার্ড বায়াসে থাকে এবং লোডে কারেন্ট প্রবাহিত হয়।
ব্রিজ রেকটিফায়ার সেন্টার-ট্যাপ রেকটিফায়ারের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় কারণ এতে সেন্টার-ট্যাপড ট্রান্সফর্মারের প্রয়োজন হয় না।
আরও পড়ুনঃ ট্রান্সফরমার কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
ফুল-ওয়েভ রেকটিফায়ার কীভাবে কাজ করে?
ফুল-ওয়েভ রেকটিফায়ার কাজ করে AC (Alternating Current) কে DC (Direct Current) তে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে। এটি সাইন তরঙ্গের উভয় অর্ধচক্র (ধনাত্মক ও ঋণাত্মক) ব্যবহার করে আউটপুট প্রদান করে। এর কাজ করার প্রক্রিয়াটি নিচে ব্যাখ্যা করা হলো:
কাজ করার ধাপ:
1. ইনপুট সিগন্যাল:
ফুল-ওয়েভ রেকটিফায়ারের ইনপুট হল একটি AC সাইন তরঙ্গ। এই সিগন্যালের একটি ধনাত্মক এবং একটি ঋণাত্মক অর্ধচক্র থাকে।
2. ধনাত্মক অর্ধচক্র:
যখন ইনপুট সিগন্যাল ধনাত্মক অর্ধচক্রে থাকে:
- সেন্টার ট্যাপ রেকটিফায়ারে: একটি ডায়োড চালিত হয় এবং আউটপুটে একটি ধনাত্মক ভোল্টেজ তৈরি হয়।
- ব্রিজ রেকটিফায়ারে: দুটি ডায়োড সক্রিয় হয় এবং আউটপুটে ধনাত্মক ভোল্টেজ তৈরি হয়।
3. ঋণাত্মক অর্ধচক্র:
যখন ইনপুট সিগন্যাল ঋণাত্মক অর্ধচক্রে থাকে:
- সেন্টার ট্যাপ রেকটিফায়ারে: অন্য ডায়োড চালিত হয় এবং আবার আউটপুটে ধনাত্মক ভোল্টেজ পাওয়া যায়।
- ব্রিজ রেকটিফায়ারে: অন্য দুটি ডায়োড সক্রিয় হয় এবং ধনাত্মক ভোল্টেজ উৎপন্ন হয়।
4. আউটপুট সিগন্যাল:
ইনপুট সিগন্যালের উভয় অর্ধচক্র থেকে ধনাত্মক ভোল্টেজ তৈরি হয়, ফলে আউটপুট একটি পালসেটিং DC সিগন্যাল হয়।
5. ফিল্টারিং (ঐচ্ছিক):
আউটপুটের পালসেটিং DC সিগন্যালকে মসৃণ DC সিগন্যাল করতে ক্যাপাসিটর ফিল্টার ব্যবহার করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ সার্কিটের ব্যাখ্যা:
সেন্টার ট্যাপ ফুল-ওয়েভ রেকটিফায়ার:
- সেন্টার ট্যাপ ট্রান্সফর্মার ইনপুট সিগন্যালকে দুটি অর্ধচক্রে বিভক্ত করে।
- ধনাত্মক অর্ধচক্রে প্রথম ডায়োড এবং ঋণাত্মক অর্ধচক্রে দ্বিতীয় ডায়োড সক্রিয় হয়।
ব্রিজ রেকটিফায়ার:
- চারটি ডায়োড দিয়ে একটি ব্রিজ গঠন করা হয়।
- ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অর্ধচক্রে দুটি ডায়োডের সমন্বয় আউটপুটে ধনাত্মক ভোল্টেজ তৈরি করে।
কাজের ধরন:
- ইনপুট সিগন্যাল: সাইন তরঙ্গ (AC)
- আউটপুট সিগন্যাল: পালসেটিং DC।
ফুল-ওয়েভ রেকটিফায়ার ইনপুট সিগন্যালের উভয় অর্ধচক্র থেকে আউটপুট সংগ্রহ করে, যা একে হাফ-ওয়েভ রেকটিফায়ার থেকে বেশি কার্যকরী করে তোলে। এটি ব্যাটারি চার্জার, পাওয়ার সাপ্লাই, এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
আরও পড়ুনঃ পি-টাইপ ও এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার কোনটি ভালো?
দুই ধরনের ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারেরই নিজস্ব সুবিধা ও অসুবিধা আছে। ব্রিজ রেকটিফায়ার সাধারণত বেশি জনপ্রিয় কারণ এটি সেন্টার-ট্যাপ রেকটিফায়ারের চেয়ে বেশি দক্ষ এবং সেন্টার-ট্যাপড ট্রান্সফর্মারের প্রয়োজন হয় না। তবে, নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনের জন্য কোনটি ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করবে ডিজাইনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর, যেমন ভোল্টেজ, কারেন্ট, এবং খরচ।
আরও পড়ুনঃ ইলেকট্রিক সার্কিটের মৌলিক ধারণা
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের সুবিধা ও অসুবিধা
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার, এসি (Alternating Current) বিদ্যুৎকে ডিসি (Direct Current) বিদ্যুতে রূপান্তর করার জন্য ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক উপাদান।
এর কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে।
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের সুবিধা:
১। উচ্চ দক্ষতা: ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার হাফ ওয়েভ রেকটিফায়ারের চেয়ে বেশি দক্ষ। এটি এসি সিগন্যালের সম্পূর্ণ চক্রকেই ডিসি সিগন্যালে রূপান্তরিত করে, ফলে শক্তি হানি কম হয়।
২। কম রিপল: আউটপুট ডিসি ভোল্টেজে রিপল কম হয়। রিপল হল আউটপুট ভোল্টেজে একটি ছোট এসি উপাদান যা ডায়োডের কারণে হয়। ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারে এই রিপল কম হওয়ায় আউটপুট ভোল্টেজ আরো স্থির হয়।
৩। ফিল্টারিং সহজ: কম রিপল থাকার কারণে ক্যাপাসিটর বা অন্যান্য ফিল্টারিং উপকরণ দিয়ে সহজেই মসৃণ DC পাওয়া যায়।
৪। সম্পূর্ণ চক্রের রূপান্তর: এটি এসি সিগন্যালের সম্পূর্ণ চক্রকেই ডিসি সিগনালে রূপান্তরিত করে, ফলে আউটপুট ডিসি ভোল্টেজের মান বেশি হয়।
৫। উচ্চ DC আউটপুট: আউটপুট সিগন্যাল তুলনামূলকভাবে বেশি মসৃণ এবং ধারাবাহিক DC পাওয়ার প্রদান করে।
৬। উচ্চ ভোল্টেজ ব্যবহারযোগ্যতা: ইনপুট ভোল্টেজের উভয় অর্ধচক্র ব্যবহার করায় পাওয়ার ট্রান্সফারের হার বেশি।
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের অসুবিধা:
১। জটিল সার্কিট: হাফ ওয়েভ রেকটিফায়ারের তুলনায় ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের সার্কিট কিছুটা জটিল। এতে বেশি সংখ্যক ডায়োড ব্যবহার করা হয়। সেন্টার ট্যাপ রেকটিফায়ারে সেন্টার ট্যাপ ট্রান্সফর্মার প্রয়োজন, যা ব্যয়বহুল এবং জটিল। ব্রিজ রেকটিফায়ারে চারটি ডায়োড ব্যবহৃত হয়, যা তুলনামূলকভাবে বেশি জটিল।
২। উচ্চ খরচ: বেশি সংখ্যক ডায়োড ব্যবহারের কারণে ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি হয়।
৩। উচ্চ ভোল্টেজ ড্রপ: ব্রিজ রেকটিফায়ারে চারটি ডায়োড ব্যবহারের কারণে ভোল্টেজ ড্রপ বেশি হয়।
৪। সেন্টার ট্যাপ ট্রান্সফর্মারের সমস্যা: সেন্টার ট্যাপ ট্রান্সফর্মার পাওয়া কঠিন এবং এর কার্যকারিতা নির্ভর করে সঠিক ট্যাপিংয়ের ওপর।
৫। ব্যয়বহুল: সার্কিটের অতিরিক্ত উপাদান এবং ফিল্টারিংয়ের জন্য খরচ বেশি।
৬। ডায়োডের রেটিং: ডায়োডগুলিকে উচ্চ ভোল্টেজ এবং কারেন্ট সহ্য করার উপযোগী হতে হয়।
৭। তাপ উৎপাদন: বেশি সংখ্যক ডায়োড থাকায় অধিক তাপ উৎপন্ন হয়। হিট সিংক প্রয়োজন হতে পারে।
৮। রক্ষণাবেক্ষণ: জটিল সার্কিট হওয়ায় ত্রুটি নির্ণয় কঠিন।
৯। খরচ: অধিক সংখ্যক ডায়োড প্রয়োজন হওয়ায় খরচ বেশি।
১০। ভোল্টেজ ড্রপ: দুটি ডায়োডের মাধ্যমে কারেন্ট প্রবাহিত হয়। মোট ভোল্টেজ ড্রপ বেশি (প্রায় 1.4V)।
আরও পড়ুনঃ কন্ডাক্টর, সেমিকন্ডাক্টর ও ইনসুলেটর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের ব্যবহার:
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে এটি ব্যবহৃত হয়। এটি এসি (Alternating Current) বিদ্যুৎকে ডিসি (Direct Current) বিদ্যুতে রূপান্তর করে, যা অনেক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য প্রয়োজনীয়।
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ারের ব্যবহার:
১। পাওয়ার সাপ্লাই: কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জার, টেলিভিশন ইত্যাদি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পাওয়ার সাপ্লাইতে ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার ব্যবহৃত হয়। এটি এসি মেইনস ভোল্টেজকে নিরাপদ এবং ব্যবহারযোগ্য ডিসি ভোল্টেজে রূপান্তর করে।
২। চার্জার: মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ক্যামেরা ইত্যাদির চার্জারে ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার ব্যবহৃত হয়। এটি এসি বিদ্যুৎকে ডিসি বিদ্যুতে রূপান্তর করে, যা ব্যাটারিকে চার্জ করতে ব্যবহৃত হয়।
৩। অডিও সিস্টেম: অডিও অ্যামপ্লিফায়ার, স্পিকার ইত্যাদি অডিও সিস্টেমে ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার ব্যবহৃত হয়। এটি অডিও সিগন্যালকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
৪। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রনিক্স: মোটর, কন্ট্রোল সিস্টেম ইত্যাদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রনিক্সে ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার ব্যবহৃত হয়।
৫। মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট: এক্স-রে মেশিন, ইসিজি মেশিন ইত্যাদি মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টে ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার ব্যবহৃত হয়।
৬। অটোমোবাইল ইলেকট্রনিক্স: গাড়ির চার্জিং সিস্টেম, ইগনিশন সিস্টেম ইত্যাদিতে ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার ব্যবহৃত হয়।
৭। রিনিউএবল এনার্জি সিস্টেম: সৌর প্যানেল থেকে প্রাপ্ত AC পাওয়ারকে DC তে রূপান্তর করতে।
৮। মোটর ড্রাইভ: মোটর চালানোর জন্য DC পাওয়ার সরবরাহ করতে।
ফুল ওয়েভ রেকটিফায়ার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহৃত হয়। এটি এসি বিদ্যুৎকে ডিসি বিদ্যুতে রূপান্তর করে, যা অনেক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য প্রয়োজনীয়। এর উচ্চ দক্ষতা, কম রিপল এবং সম্পূর্ণ চক্রের রূপান্তরের কারণে এটি অন্যান্য রেকটিফায়ারের তুলনায় বেশি জনপ্রিয়।
আরও পড়ুনঃ রেকটিফায়ার কি? রেকটিফায়ার কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা